যে বিষয়ে মনোযোগী হওয়া দরকার by ফরিদুল আলম

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক শুধু এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ নয় যে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের তিন-চতুর্থাংশ ভারত দ্বারা বেষ্টিত, বরং এই সম্পর্কের ঐতিহাসিক গুরুত্বও যথেষ্ট। যদিও বর্তমান সময়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শক্তির বিবেচনায় বাংলাদেশ কোনোভাবেই ভারতীয় সামর্থ্যের কাছাকাছি যাওয়ার দাবি রাখে না, তথাপি ভারত তার নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের প্রয়োজনে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করে।


প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আসন্ন বাংলাদেশ সফর এবং সম্ভাব্য আলোচ্য বিষয়গুলোর বিশ্লেষণে উপরোক্ত বক্তব্যের যথার্থতা উপলব্ধি করা যায়। যদিও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে গত প্রায় ৪০ বছর সময়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অনেকগুলো শীর্ষ পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু গুরুত্বের বিচারে এগুলোর মধ্যে তিনটি বৈঠক আলাদাভাবে আলোচনার দাবি রাখে। প্রথমটি ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব বৈঠক, যার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ভারতের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদানে অঙ্গীকার করা হয়। দ্বিতীয়টি ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে হাসিনা-দেবগৌড়া বৈঠক, যেখানে আবারও ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা-সংক্রান্ত ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং তৃতীয়টি ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ হাসিনা-মনমোহন সিংয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠক, যেখানে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচিত হয়। কিছু বিষয় ইতিমধ্যে বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে মীমাংসিত এবং ওই বৈঠকের চূড়ান্ত পরিণতি মনমোহন সিংয়ের আসন্ন সফরে অর্জিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ পর্যায়ে আরেকটি বিষয়ের অবতারণা প্রাসঙ্গিক মনে করছি আর তা হলো ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যতটুকু কৌশলগত দিক থেকে বিবেচনা করা যায়, তার চেয়েও অনেক বেশি বিবেচনা করা হয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ভূমিকা নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে 'রাষ্ট্র পর্যায়ের বন্ধুত্ব' ব্যক্তি পর্যায়ের বন্ধুত্বের মতো নয় বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতা হলো প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বব্যবস্থায় প্রতিটি রাষ্ট্র তার জাতীয় স্বার্থকে সর্বাগ্রে স্থান দেবে আর ভারতের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র_যেখানে জনগণের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতা অনেক বেশি, তাদের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই বাস্তবতা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিক নৈপুণ্য যথাযথ প্রয়োগের দ্বারা সুচতুরভাবে 'দর কষাকষি'র মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থের সংরক্ষণই হচ্ছে রাষ্ট্রগুলোর জন্য সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বৈধ পন্থা। এ বিষয় বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আসন্ন সফর কেবল একটি সফর নয় বরং এর মাধ্যমে দুটি রাষ্ট্রের দর কষাকষির সামর্থ্যও প্রতিফলিত হবে_এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। যদিও দুটি দেশের শীর্ষ পর্যায়ের আসন্ন বৈঠকের আলোচ্যসূচি নিয়ে কোনো পক্ষ থেকেই এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি, তবে অনুমান করা হচ্ছে কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবারের বৈঠকে আলোচনা হতে যাচ্ছে যার মধ্যে ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে 'করিডর' হিসেবে ব্যবহার করা (যদিও ক্ষেত্রবিশেষে 'ট্রানজিট' ও 'ট্রানসশিপমেন্ট' শব্দ দুটির প্রয়োগ করা হচ্ছে), তিস্তার পানিবণ্টন সংক্রান্ত বিষয়, ভারত কর্তৃক সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, সীমান্ত হত্যা, ঢাকা-আগরতলা বাস যোগাযোগ ইত্যাদি। এসব সম্ভাব্য বিষয়াদি থেকে বাংলাদেশ কতটুকু দর কষাকষি করতে পারবে, তা অনুমান করতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হব ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হাসিনা-মনমোহন সিংয়ের বৈঠকের দিকে। সেই বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে বাংলাদেশকে কতিপয় বিষয়ে আশ্বাস প্রদান করা হয়েছিল, যেমন আগামী আড়াই বছর সময়ের মধ্যে ভারত বাংলাদেশের কাছে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বিক্রি করবে, বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সহজশর্তে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদান করবে, সীমান্ত সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকাসহ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখবে ইত্যাদি। এর বিপরীতে ভারতের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশের কাছে কিছু দাবিনামা পেশ করা হয়। যেমন_বাংলাদেশকে 'করিডর' হিসেবে ব্যবহার করা (যা 'ট্রানজিট' নামে বহুল পরিচিত), আমদানি-রপ্তানির সুবিধার্থে মংলা বন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে দেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সেই বৈঠকের পর থেকে ২০ মাস সময় অতিক্রান্ত হলেও বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎও আহরণ করতে পারেনি। কয়েক মাস আগে ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফর করে বাংলাদেশের জন্য ভারতের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু ঋণচুক্তির শর্ত মোতাবেক বাংলাদেশ যেসব অবকাঠামোগত উন্নয়নে ওই অর্থের ব্যবহার করবে, তা ভবিষ্যতে প্রকারান্তরে ভারতেরই প্রয়োজনে ব্যবহৃত হবে, উপরন্তু বাংলাদেশ সরকারকে আগামী ২৫ বছর সময়ের মধ্যে ওই ঋণের অর্থ সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হবে। ভারতের পক্ষ থেকে আমাদের কাছে যেসব দাবি পেশ করা হয়েছিল, সে বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া এবং প্রস্তুতিও উল্লেখ করার মতো। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, বাংলাদেশ সরকার 'করিডর' সংক্রান্ত বিষয়ে ইতিমধ্যে ভারতকে 'সবুজ সংকেত' দিয়েছে, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের কারাগারে আটক ভারতের উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর শুরুর আগেই তাদের কাছে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিছু দিন আগে উলফা নেতা অরবিন্দ রাজখোয়াকেও বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আটকের পর ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সুতরাং দর কষাকষির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে আমরা দেখতে পাব যে গত ২০ মাস সময়ে বাংলাদেশ সরকার কেবল 'টিপাইমুখ বাঁধ' নির্মাণের বিষয়ে ভারতকে সম্মত করাতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে বহুল আলোচিত 'করিডর' প্রদানের বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে কি পরিমাণ আর্থিক সুবিধা অর্জন করবে, সে বিষয়ে কোনো পক্ষ থেকেই কোনো প্রকার উচ্চবাচ্য লক্ষ করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে উল্লেখ্য যে যদি 'ট্রানজিট' শব্দ ব্যবহার করে করিডর প্রদান করা হয়, তবে আইনত কোনো প্রকার ফি ধার্য করার সুযোগ থাকে না। এ কথা অনস্বীকার্য যে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তথ্য অধিকার এবং মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করেছে, তবে জনকল্যাণে এসব কমিশনের ভূমিকা কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ, তা না হলে এই তথ্য অধিকারের সময়ে ভারত-বাংলাদেশ আসন্ন বৈঠকের বিষয়ে জনগণের আগ্রহ সত্ত্বেও কোনো প্রকার তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে না এবং সরকার যেসব বিষয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সে বিষয়েও কতটুকু জনমত আছে তাও ভাবা হচ্ছে না। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে গত এক বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের সহস্রাধিক নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। মানবাধিকারের সর্বজনীন নীতি এ ক্ষেত্রে ভারত কর্তৃক লঙ্ঘিত হচ্ছে বারবার, প্রায়ই বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য তুলে ধরলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো জোরালো প্রতিবাদ উচ্চারিত হতে শোনা যায় না। এ রকম একটি বিষয় দু-দেশের শীর্ষ পর্যায়ে উত্থাপিত হওয়া উচিত হলেও সরকার সম্ভবত মনে করছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে বিব্রত করা উচিত নয়; বরং বাংলাদেশ সরকারকে এ ভেবেই সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে যে সাম্প্রতিককালে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর শেষ করে যাওয়ার আগে বাংলাদেশকে কথা দিয়েছেন, ভবিষ্যতে যেন এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে_এ বিষয়ে ভারত সতর্ক থাকবে। আমরা এ কথা কখনো ভাবতে চাই না যে তুলনামূলক ছোট রাষ্ট্র বিধায় বাংলাদেশের কোনো দর কষাকষির সামর্থ্য নেই। অবশ্যই আছে এবং বেশ ভালোই আছে কিন্তু আমরা কোথায় যেন বেশ আবেগপ্রবণ, সেই আবেগের খোলস ছেড়ে বাস্তবতায় ফিরে আসা এই মুহূর্তে খুবই জরুরি, যেমনটা জরুরি আমাদের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিকে পুনর্মূল্যায়ন করা এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিরূপণে বাংলাদেশের 'ভারতনীতি' প্রণয়নের মতো বিষয়ে মনোযোগী হওয়া।
লেখক : চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.