ভারসাম্য রক্ষার ওপরই জোর দিতে হবে-ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, না আয় বৃদ্ধি?

প্রায় দুই বছর আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হওয়ার অর্জনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যাপন করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে এই উদ্যাপনের কী মাহাত্ম্য ছিল, তা তখনই বোধগম্য হয়নি। তবে এই অর্জন প্রকৃত অর্থে টেকসই হয়নি। বরং বাড়তি আমদানি ব্যয় মেটানোর চাপ সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। কমে যাচ্ছে রিজার্ভ। বেড়ে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের হার তথা ডলারের দাম।


আর এই চাপ তৈরি হয়েছে পণ্য ও সেবা খাতের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার বিপরীতে রপ্তানি ও প্রবাসী-আয়ের প্রবাহ শ্লথ হয়ে পড়ায়। বিস্তৃত পরিসরে দেখলে, বাইরের জগতের সঙ্গে নিয়মিত বিভিন্ন লেনদেনের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ ব্যয় বেড়েছে, তা মেটাতে বাইরে থেকে সমপরিমাণ আয় করা যাচ্ছে না। ফলে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এটা অর্থনীতির জন্য ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে।
এর অন্যতম কারণ অদূরদর্শী নীতি পরিচালনা। যে দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক হাজার কোটি ডলারের রিজার্ভ নিয়ে খুশিতে ডগমগ হয়, যে দেশে নীতিনির্ধারকেরা বৈশ্বিক অর্থনীতির গতিপ্রবাহকে দূরদৃষ্টিতে অনুধাবন করতে পারেন না, যে দেশে জনতুষ্টির চেষ্টায় অর্থায়নের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়া বড় বড় নির্মাণ প্রকল্প শুরু করা হয়, সে দেশের অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হতে বাধ্য। অথচ অর্থনীতিতে গতিময়তা সঞ্চার করতে হলে, উচ্চতর প্রবৃদ্ধির পথে চালিত করতে হলে সামগ্রিক চাহিদা জোরদার করার দিকে নজর দিতে হয়। এ জন্য প্রয়োজন বড় বিনিয়োগ। আর বিনিয়োগের জন্য চাই অর্থায়ন। তবে চাহিদা তৈরি থেকে অর্থায়ন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে দূরদর্শিতা ও টেকসই ব্যবস্থাপনা জরুরি। তা না হলে তুলনামূলক অনুৎপাদনশীল খাত উৎসাহিত হতে পারে বা ব্যয়ের প্রকৃত অগ্রাধিকার হারিয়ে যেতে পারে।
সরকারের তিন বছর পূর্ণ হওয়ার প্রাক্কালে অর্থনীতিতে যে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিচ্ছে, তা মোকাবিলা করা খুব কঠিন বা অসম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন নীতি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় কিছু গুণগত পরিবর্তন, প্রয়োজন নীতি-ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পরিকল্পিত সমন্বয় সাধন। প্রশ্ন হতে পারে, কত দ্রুত এটি করা সম্ভব? উত্তরটা হলো, চটজলদি সমাধান নেই, কিছুটা সময় লাগবেই। অর্থনীতির ‘বিজনেস সাইকেল’ তত্ত্বের আলোকে পর্যালোচনা করলে এ রকম উত্তরই মিলবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিকে পুরোপুরি এই তত্ত্বের সঙ্গে মেলানো যাবে না। আবার ভারসাম্যহীনতার বিষয়টি সরকার স্বীকার না করলে সমাধান দুঃসাধ্য হয়ে পড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ বনাম আয় বৃদ্ধির বিষয়টি চলে আসছে। এটাও ঠিক যে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ যতটা সহজ, আয় বৃদ্ধি ততটা সহজ নয়। কিন্তু ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আরেক দফা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা থেকে যায়।
সুতরাং, ভারসাম্য মোকাবিলার পদক্ষেপ কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণই হবে। অর্থনীতির ভারসাম্যহীনতা ঠিক করতে হলে সরকারকে বাস্তবতার কঠিন নিরিখে জনতুষ্টির মোহ থেকে সরে আসতে হবে, সংকীর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনা বাদ দিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.