ফিরে দেখা-ইতিহাসের দুর্লঙ্ঘ যাত্রা by শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী

খন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। তাদের কঠোর সাজা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে সমগ্র জাতি। কত সভা, মিছিল, টক শো, গোলটেবিল বৈঠক, মানববন্ধন, লেখালেখি করতে হয়েছে সবার এ দিনটির জন্য, তার কোনো হিসাব নেই মহাকালের পাতায় এক বিন্দু শিশিরকণা হলেও আমাদের কাছে এ বিশটি বছর ছিল দুস্তর, দুরতিক্রম্য দীর্ঘ পথ। কত চড়াই-উতরাই, নৈরাশ্য, উৎপীড়ন। কিন্তু পথ ছাড়েননি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পোড় খাওয়া কুশীলবরা।


শহীদজননী জাহানারা ইমাম আন্দোলনের মশাল হাতে নেমেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন অদম্য, দুঃসাহসী সহযাত্রীরা। উজ্জ্বল একঝাঁক জ্যোতিষ্কমণ্ডলী। না, কিছু চাই না। ক্ষমতা নয়, রাজ্যপাট নয়, অর্থ-বিত্ত নয়। শুধু ফিরে পেতে চাই আমার নিজ ঘর, আমার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ভূলুণ্ঠিত হওয়া, পাঁকে ডুবে যাওয়া আমার সেই স্বপ্ন_ যাতে ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার কথা, ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের কথা, শোষণ-লুণ্ঠনহীন এক সোনার বাংলার কথা। চাই সেই সংবিধান, যা বাহাত্তরের সংবিধান নামে বিশ্বখ্যাত।
একটি স্টম্ফুলিঙ্গ থেকে লাখো স্টম্ফুলিঙ্গ আজ সারাদেশে। ১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি শুরু হয় এই কঠিন পথচলা। ১০১ জন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক সুধীজন নিয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করা হয়। নরঘাতক, দুরাচার গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদান ও দলের আমির ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ জানানোর মধ্য দিয়ে আন্দোলন দানা বাঁধে। নির্মূল কমিটির ঘোষণায় বলা হয়, বেআইনিভাবে বাংলাদেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে যদি দেশ থেকে বহিষ্কার করা না হয় তাহলে এই ঘৃণ্য পাকিস্তানি দালাল ও যুদ্ধাপরাধের নীল নকশা প্রণয়নকারীকে গণআদালতে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কথাবার্তাও ছিল। নেতৃবৃন্দ দেশব্যাপী জনমত সংগঠিত করতে লাগলেন। এক নতুন আবেগে সমগ্র জাতি জেগে উঠল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই_ এ দাবি সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ল কোটি জনতার অন্তরে। সোচ্চার হলো মানুষ।
১৯৯২, ২৬ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সেই রেসকোর্স, আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আবার কানায় কানায় পূর্ণ হলো। খালেদা জিয়ার সরকারের সব বাধা উপেক্ষা করে ছুটে এসেছিল আপামর গণমানুষ এই প্রতীকী বিচার দেখতে। বিচারে গণরায় হলো_ গোলাম আযমের ফাঁসি। ফাঁসি, ফাঁসি, ফাঁসি, জনসমুদ্রের ভয়াল গর্জন।
আর পেছন ফেরা নয়। পুরোদমে শুরু হলো আন্দোলনের পরবর্তী কার্যসূচি। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠনের প্রস্তুতি চলল। ক্রমান্বয়ে দেশের গণ্ডির বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল আন্দোলনের ঢেউ। বিভিন্ন দেশে কমিটির শাখা গঠিত হলো। শহীদজননী ক্যান্সারের তীব্রতা উপেক্ষা করে ছুটলেন শহর থেকে শহরে। সঙ্গে তার অকুতোভয় সহযোদ্ধারা। জনমত সৃষ্টি হতে থাকল। প্রতিটি সভায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। মিথ্যার কালো পর্দা উন্মোচন করে সত্যের আলো পথ দেখাল।
এখন ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডেও নির্মূল কমিটির শাখা গড়ে উঠেছে। দেশজুড়ে হয়েছে শতাধিক। নতুন প্রজন্মের ছাত্র, যুব, নারী, রাজনীতিক, সাধারণ মানুষ, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী এখন নির্মূল কমিটির সদস্য। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সবার কাছে তুলে ধরার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে শতাধিক 'মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার'।
এ পর্যন্ত পেঁৗছাতে সংগঠনকে পাড়ি দিতে হয়েছে বিপদসংকুল পথ। সহ্য করতে হয়েছে সীমাহীন দুর্ভোগ, লাঞ্ছনা। খালেদা জিয়া গণআদালতের ২৪ জন উদ্যোক্তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন। শেখ হাসিনার আমলে তারা এই মিথ্যা মামলার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন। সাজানো, বানোয়াট অপবাদ দিয়ে নির্মূল কমিটির দুই প্রাণপুরুষ মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবিরকে জেলে পুরে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। আমাদের অসংখ্য কর্মী, সদস্যকে ২০০২-এ বাস্তুহারা করা হয়েছে। নানাভাবে অত্যাচার করা হয়েছে। ক্যাডার বাহিনীর দুষ্কৃৃতকারীরা অসংখ্য সংখ্যালঘু ও নির্মূল কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মেয়েদের গণধর্ষণ করেছে। ওদের পক্ষে কথা বলার জন্য আমরা অনেকেই খালেদা-নিজামী সরকারের কোপানলের শিকার হয়েছি। আমি ৩৬ বছরের চাকরিস্থল উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিনা নোটিশে চাকরিচ্যুত হয়েছি। আমার অপরাধ ছিল, আমি গণধর্ষিত পূর্ণিমার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম এবং জেলে আটক শাহরিয়ার কবিরের মুক্তির জন্য মানববন্ধন করেছিলাম। জোট সরকারের কাছে এ দুটি কাজই ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ। তাই আমাকে ওই শাস্তি ভোগ করতে হলো। ওদের পেটোয়া বাহিনী আল কায়দা আমাকে চিঠি লিখেছে, একাত্তরে আমাদের মুরবি্বরা তোর স্বামী ডা. আলীম চৌধুরীর সঙ্গে তোকে না মেরে ভুল করেছে। এবার তোর পরিবারসহ তোকে খুন করব। শুধু আমি নই। আমাদের অনেকেই এমনতর নিপীড়ন অহরহই ভোগ করছেন।
কিন্তু আমরা তবুও পথ ছাড়ব না। আমাদের দিশারি শহীদজননী জাহানারা ইমাম। তিনি আমাদের কঠিনভাবে তৈরি করে গেছেন আপসহীন সংগ্রামের পথে। তার শেষ চিঠি আমাদের চলার দিকনির্দেশিকা। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে কষ্ট করে ওই চিঠিটি লিখেছিলেন, যার মূল কথা ছিল_ যতদিন পর্যন্ত না আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জিত হবে ততদিন আন্দোলন চলবে।
এখন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। তাদের কঠোর সাজা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে সমগ্র জাতি। কত সভা, মিছিল, টক শো, গোলটেবিল বৈঠক, মানববন্ধন, লেখালেখি করতে হয়েছে সবার এ দিনটির জন্য, তার কোনো হিসাব নেই। একাত্তরের ঘাতক জামায়াত, রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ এবং বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া_ এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিটি সদস্য আমরণ লড়াই করবে। এ আমাদের দৃঢ়প্রত্যয়। শহীদজননীর উদ্দেশে আমাদের প্রতিক্ষণের নিবেদন_
তোমার পতাকা যারে দাও তারে
বহিবারে দাও শকতি।

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.