যুদ্ধদিনের বন্ধু-ম্যারিয়েটা ও বিলেতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ by মহিউদ্দিন আহমদ

ম্যারিয়েটা—পুরো নাম ম্যারিয়েটা প্রকোপে। বয়স ২৪-২৫, লম্বা, ছিপছিপে গড়ন, স্মাট এবং সুন্দরী এক তরুণী। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় খুব সম্ভব অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। তার বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, কথাবার্তার স্টাইল যেকোনো মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। তরুণদের তো বটেই। এক বাঙালি তরুণের—এখন দেশজোড়া খ্যাতি, তার দারুণ অনুরক্ত ছিল ম্যারিয়েটা।


একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কোটি কোটি মানুষের জীবন ওলটপালট করে দেয়। ওলটপালট করে দেয় কিছু বিদেশিরও। এই বিদেশিদের দুজন ছিল পল কনেট নামের এক তরুণ স্কুলশিক্ষক। তার স্ত্রী ঈলিন এবং এই ম্যারিয়েটা। একাত্তরের ২৫ মার্চের পর থেকে এই তিনজন লন্ডনে এবং আরও কতগুলো জায়গায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে দাঁড়াল। ঈলিন কনেট একাত্তরের আগস্ট মাসে কিছু রিলিফ সামগ্রী নিয়ে যশোর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ল। তার কারাদণ্ডও হলো পাকিস্তানি সেনাদের বিচারে। জেলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর জানা গেল ঈলিন অন্তঃসত্ত্বা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরই ঈলিন মুক্ত হলো।
আর ম্যারিয়েটা? তার নর্থ ওয়েস্ট লন্ডনের ৩৪ স্ট্র্যাটফোর্ড ভিলার ফ্ল্যাটটিই দিয়ে দিল ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য। যতটুকু মনে পড়ে ‘অপারেশন ও মেগা’ নামের সংগঠনটির অফিসও ছিল ম্যারিয়েটার এই বাড়িতে। এই ‘অপারেশন ওমেগা’র একজন সদস্য হিসেবেই আরও কয়েকজনের সঙ্গে ঈলিন কনেট ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছিল।
এই গ্রুপে পল কনেটের পরের অবস্থানে ছিল ম্যারিয়েটা। একাত্তরে এই ম্যারিয়েটার ভূমিকা সম্পর্কে লন্ডনের বাংলা সাপ্তাহিক নতুন দিন-এর ১৮-২৪ ডিসেম্বর সংখ্যায় সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক—এখন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, তাঁর একাত্তরের স্মৃতিচারণায় বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ম্যারিয়েটার এমন প্রবল উত্সাহ এবং আগ্রহ সম্পর্কে ম্যারিয়েটাকে জিজ্ঞেস করা হলে ম্যারিয়েটা জবাবে এই কথাগুলো বলে, ‘যেখানে একটি পশুশক্তি এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিঃসহায় মানুষগুলোর ওপর, সেখানে কী করে অন্য দেশের মানুষেরা বসে থাকতে পারে? মানুষকে তার দেশ-গোত্রের ভিত্তিতে আলাদা করে দেখাটা মস্ত বড় অন্যায় নয় কি?’
মুক্তিযুদ্ধে মানিকেরও প্রবল অংশগ্রহণ ছিল। সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সুনামগঞ্জ বা হবিগঞ্জের এক আইনজীবী আফরোজ আফগান ২৫ মার্চ থেকেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সামনের ফুটপাতে অনশন শুরু করে। মানিক ব্যক্তিগতভাবেও ঘনিষ্ঠ ছিল পল, ঈলিন ও ম্যারিয়েটার।

দুই.
বাংলাদেশের প্রতি ম্যারিয়েটার এই অঙ্গীকার, ‘কমিটমেন্ট’ আমিও কয়েকবার দেখেছি। এমন একটি স্মৃতি আজ ৪০ বছর পরও প্রজ্জ্বলন করে। তারিখটি খুব সম্ভব একাত্তরের ২৬ সেপ্টেম্বর। বিকেলে লন্ডনের হাইড পার্কে মুক্তিযুদ্ধের ছয় মাস পূর্তি উপলক্ষে জনসভা। আয়োজক ‘বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি’, সভাপতি এই অ্যাকশন কমিটির কনভেনর এ জেড মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু, এখন চন্দ্রা স্পিনিং মিলসের মালিক—মোখতার।
এই দিন বেলা ১১টার দিকে লন্ডনের পিকাভিলিতে অবস্থিত তসদ্দুক আহমদের ‘গঙ্গা’ নামের রেস্টুরেন্টে ছোট একটি ‘গেট টুগেদার’ ন্যাপের এক অংশের নেতা পাকিস্তানের খান ওয়ালী খান পাকিস্তানের চলমান সংকটের ওপর কিছু কথা বলবেন, ১৫-২০ জনের মধ্যে আমিও আমন্ত্রিত। ঘণ্টা দুয়েক চমত্কার ইংরেজিতে নিচুস্বরে সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সমর্থন এবং আমাদের সুনিশ্চিত বিজয় সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ আমাদের শোনালেন।
এখান থেকে বের হয়ে হাইড পার্কের সভায় যাচ্ছিলাম। পার্কে ঢুকতেই দেখি ম্যারিয়েটা ও তার বয়সী অ্যাকশন বাংলাদেশের আরও এক তরুণী কর্মী, এত বছর পরও নামটি মনে আছে—রেবা ফনসেকা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পাশে মাটিতে দু-তিনটি কার্টুন। আমাকে দেখেই যেন তাদের ‘সংকট’ উবে গেল। আমাকে উদ্দেশ করে ম্যারিয়েটার হুকুম, আদেশ বা অনুরোধ, ‘মহিউদ্দিন, প্লিজ হেলপ আস।’ তাদের সংকটটা ম্যারিয়েটাই আমাকে ব্যাখ্যা করল, এই কার্টুনগুলো তারা সভাস্থলে নিয়ে যেতে পারছে না, আমাকে সাহায্য করতে হবে। দেখলাম, কার্টুনগুলোতে কতগুলো টি-শার্ট—টি-শার্টগুলোর বুকে-পিঠে লেখা—‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘রিকগনাইজ বাংলাদেশ’। ভারী কার্টুনগুলোর একটি আমি কাঁধে তুলে নিলাম, আর একটি তারা দুজন ধরাধরি করে সভাস্থলে নিয়ে গেল। তাদের উদ্দেশ্য টি-শার্টগুলো সভায় বিক্রি করবে। সভাশেষে যখন হাইড পার্ক ছাড়ছি, তখন আবার এই দুই তরুনীর সামনে পড়লাম। পাশের কার্টুন দুটোর মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই, টি-শার্টগুলো আগের মতোই কার্টুনে, অক্ষত। জিজ্ঞেস করলাম, কী হলো, তোমাদের টি-শার্টগুলো বিক্রি হলো না?
ম্যারিয়েটার জবাব, লন্ডন মেট্রোপলিটান পুলিশ তাদের টি-শার্টগুলো বিক্রি করতে দেয়নি। কারণ, ‘কমার্শিয়াল ট্র্যানজ্যাকশনস নট অ্যালাউড ইন হাইড পার্ক।’ জিজ্ঞেস করলাম, আর সাহায্য লাগবে, গাড়ি বা ট্যাক্সিতে তুলে দেব? ‘নো থ্যাঙ্কস। আমরা অ্যাকশন বাংলাদেশের লোক পেয়ে গেছি, তারা সাহায্য করবে।’ ম্যারিয়েটার উত্তর।

তিন.
ম্যারিয়েটার তত্পরতা আর একবার দেখলাম, ইংল্যান্ডের সমুদ্রসৈকত বাহর ব্রাইটনে, লেবার পার্টির বার্ষিক সম্মেলনে, খুব সম্ভব একাত্তরের অক্টোবরের প্রথম দিকে। আমরা বাঙালিরা দাবি তুললাম, আমাদের আন্দোলন, সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই সম্মেলনে আলোচনা হতে হবে, আমাদের দেশ ও সরকারকে স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে প্রস্তাব পাস করতে হবে। আমরা ‘ক্যাম্পেইন’ চালাতে থাকলাম লেবার পার্টির প্রতিনিধিদের কাছে, আমাদের বিষয়টা তাদের সম্মেলনে এজেন্ডাভুক্ত করতে। তাদের কেউ কেউ হালকাভাবে আমাদের জিজ্ঞেস করে, কত বছর আছ এ দেশে। যদি বলি, পাঁচ বছর, তখন প্রশ্ন, তোমরা কি আমাদের লেবার পার্টির সদস্য? তাদের প্রশ্নে বিপদে পড়ে যাই, বলি এখনো হইনি। তখন তাদের কথা, ‘আমাদের সদস্য হওনি তোমরা, তোমাদের বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করব কেন?’
আলোচনা, বিতর্ক তারপরও হয়েছিল, আধা ঘণ্টার। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তারা সমর্থন জানিয়েছিল। তখন কিন্তু ক্ষমতায় ছিল কনজারভেটিভ পার্টি, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এডওয়ার্ড হিথ। আর বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন হ্যারল্ড উইলসন, হিথ সাহেবের আগে এবং পরে দুবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী।
এই সম্মেলন চলাকালে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বিভিন্ন ছোট-বড় হল, কামরায় আলোচনা হয়েছে। এমন একটি আলোচনা সভা ছিল বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর ছোট একটি রুমে ৫০-৬০ জনের উপস্থিতিতে, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে। সভায় বিভিন্ন বক্তা এবং প্রশ্নকারীর প্রশ্নগুলো টুকে নিলেন ম্যারিয়েটা, তাদের নাম-ঠিকানাসহ। বাংলাদেশের ওপর প্রকাশিত বিভিন্ন পুস্তিকা, প্রচারপত্র, কাগজপত্র পাঠানোর দায়িত্ব নিল বাংলাদেশ ভক্ত ম্যারিয়েটা।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়টাকে ম্যারিয়েটাও তার নিজের বড় এক সাফল্য হিসেবে দেখেছিল। আমাদের বিজয়ে তার উচ্ছ্বাস, উল্লাসও আমাদের বাঙালি তরুণ-তরুণীদের মতোই ছিল। ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারি বা মার্চের দিকে বাংলাদেশে এসেছিল ম্যারিয়েটা, কয়েক দিন থেকেছিলও। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ফিরে গিয়ে কিছুদিন পর এই উজ্জ্বল তরুণী, ম্যারিয়েটা আত্মহত্যা করল। তার মৃত্যুর পর পল কনেটকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, জীবনশক্তিতে ভরপুর এ মেয়েটা আত্মহত্যা করল! পল তখন বলেছিল, আমিও জানতাম না যে সে ডিপ্রেশনে ভুগত কখনো কখনো। জানলে আমি কিছু ব্যবস্থা হয়তো নিতে পারতাম, তাকে নিয়ে সতর্ক থাকতাম।

চার.
ম্যারিয়েটার মৃত্যুর পর একটি স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছিল ট্রাফালগার স্কয়ারের গির্জাটিতে। এই ট্রাফালগার স্কয়ারে বাংলাদেশকে নিয়ে পল কনেট ও ম্যারিয়েটার বেশ কিছু কার্যক্রম ছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি ছিল একাত্তরের ১ আগস্ট রোববার, যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাঙালিদের বৃহত্তম সমাবেশ। শুনেছিলাম তখন, বাঙালি জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ব্রিটেনের প্রায় সব বাংলাদেশি সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শত শত বাসভর্তি মানুষজন এই সভায় অংশগ্রহণ করেছিল। এ সভাতেই শুধু বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে জানিয়ে তাঁর বাসা থেকে তাঁর সঙ্গে একই ট্যাক্সিতে ট্রাফালগার স্কয়ার উপস্থিত হয়ে আমার পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলাম। আমি তখন পাকিস্তান হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি।
এরপর কয়েকবার পল কনেট ও ম্যারিয়েটা আমাকে ঠাট্টা করে বলল, তুমি অপ্রত্যাশিতভাবে তোমার পদত্যাগের ঘোষণাটি দিয়ে আমাদের সমাবেশটা ‘হাইজ্যাক’ করে নিলে, পত্রপত্রিকা, টিভি ও রেডিও তোমাকে নিয়ে শিরোনাম দিল, খবর করল।
এই মেমোরিয়েল সার্ভিসে চমত্কার আবেগঘন একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন ফারুক চৌধুরী। তখন তিনি লন্ডনে বাংলাদেশের নতুন এবং প্রথম ডেপুটি হাইকমিশনার। ড. কামাল হোসেনও উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি আইনমন্ত্রী, বাংলাদেশের সংবিধান রচনায় ব্যস্ত, দেশ-বিদেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিচ্ছেন। সংবিধান রচনায় তখন আর্থিক সাপোর্ট দিচ্ছিল কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েট।
ফারুক চৌধুরীর বক্তৃতায়ই প্রথম জানলাম, ম্যারিয়েটার বাবা একজন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তাঁরা দুজন ইউরোপের কোনো একটি রাজধানীতে একত্রে কাজ করেছিলেন।
মনে আছে, অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলামের স্ত্রী রুনী ইসলাম। তাঁরা হারমোনিয়ামসহ গেয়েছিলেন, ‘আজ জ্যোত্স্না রাতে সবাই গেছে বনে’। অনুষ্ঠান শেষে মানিক বলেছিল, এ গানটি ম্যারিয়েটার খুব প্রিয় ছিল, গুনগুন করে মাঝেমধ্যে গাইতে চেষ্টা করত।
এত বছর পর আজও ভুলতে পারি না, গির্জায় ঢোকার পথে হাতের বাম পাশে একটি টেবিলে ম্যারিয়েটার চেয়ারে বসা একটি ছবি।
ম্যারিয়েটা ছবিতে হাসছে, তার পরনে একটি শাড়ি।
মহিউদ্দিন আহমদ: একাত্তরে যুক্তরাজ্যে প্রথম বাঙালি পদত্যাগকারী কূটনীতিবিদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক।
mohiuddinahmed@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.