প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার করুন-শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

জ ১৪ ডিসেম্বর। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের উৎসব উদ্যাপনের ঠিক আগেই গভীর বেদনা নিয়ে আসে এই দিনটি—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। শোকার্ত হূদয়ে আমরা স্মরণ করি জাতির সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, স্বাধীনতাসংগ্রামের সূচনা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক আগের মুহূর্ত পর্যন্ত যাঁদের আমরা হারিয়েছি: অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশেদুল হাসান, ড. আনোয়ার পাশা, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা
কায়সার, নিজামুদ্দীন আহমেদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, সাহিত্যিক সেলিনা পারভীন প্রমুখ। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তিতে আমরা তাঁদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। আন্তরিক সহমর্মিতা প্রকাশ করছি তাঁদের পরিবার-পরিজনের প্রতি, দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে যাঁরা বয়ে চলেছেন স্বজন হারানোর গভীর বেদনা ও শোক।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পরাজয়ের আগমুহূর্তে পরিকল্পিতভাবে বেছে বেছে হত্যা করেছিল জাতির অগ্রণী শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের। তারা হয়তো চেয়েছিল, সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ যেন মেধায়-মননে দীন হয়ে পড়ে, যেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। আসন্ন পরাজয়ের প্রতিহিংসা আগাম চরিতার্থ করতেও তারা বেছে নিয়েছিল ওই নৃশংস কৌশল, যা আসলে কাপুরুষতা।
বুদ্ধিজীবী নিধনের ঘটনাটির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, দেশেরই কিছু মানুষ তা ঘটানোর ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে। রাজাকার, আলবদর আর আলশামস বাহিনীর সদস্যদের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষে এতটা ব্যাপক এবং লক্ষ্যভেদী হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব ছিল না। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুদ্ধিজীবীদের উঠিয়ে এনেছে; তুলে দিয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেরাই হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করেছে। আর কী গ্লানির বিষয় যে সেই বিশ্বাসঘাতকদের অনেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজে ও রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে, এমনকি মন্ত্রিত্বও পেয়েছে! পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা আজও স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সক্রিয়।
তবে স্বস্তির বিষয়, একাত্তরে মানবতার বিরুদ্ধে যারা অপরাধ সংঘটিত করেছে, তাদের বিচারের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। প্রধান অভিযুক্তদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র পেশ করা হয়েছে। সেসব অভিযোগের মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতার অভিযোগও রয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধগুলোর মধ্যে সর্বাধিক পরিকল্পিত অপরাধ, ঠান্ডা মাথায় ঘটানো নিধনযজ্ঞ। এই জঘন্যতম অপরাধযজ্ঞের অগ্রভাগে ছিল এ দেশেরই কিছু মানুষ—রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। সুতরাং বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞের বিচার অবশ্যই বিশেষ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দাবি করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রতিটি ঘটনা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে প্রয়োজনে নতুন করে গভীর তদন্ত চালাতে হবে। প্রত্যেক শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এভাবেই দেশে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে। এভাবেই জাতি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.