অধিকার-জারোয়া আদিবাসী ও 'নগ্নতা'র রাজনীতি by পাভেল পার্থ

দিবাসী জনগণের জন্য 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০' চূড়ান্ত হলেও ওই আইনে আদিবাসী জনগণকে নিয়ে ভুল, মিথ্যা ও অন্যায় উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কোনো ধারা রাখা হয়নি। আশা করছি, আদিবাসীদের প্রতি সব বৈষম্য দূর হবে এবং সমূলে নিশ্চিহ্ন হবে আদিবাসী জনগণকে নিয়ে ক্ষমতাধর উপস্থাপনের 'নগ্নতার রাজনীতি'।


ভারতের আন্দামানের জারোয়া কিংবা বাংলাদেশের আদিবাসীই হোক, সবার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ঘূর্ণিঝড় সুনামির পর নিজস্ব লোকায়ত দুর্যোগ মোকাবেলা বিজ্ঞান দিয়ে বেঁচে যাওয়া আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের জারোয়া, ওঙ্গি ও সোমপেন আদিবাসীরা তথাকথিত 'আধুনিক দুনিয়া'র এক চিলতে 'আশ্চর্যে'র খবরে পরিণত হয়েছিলেন। দুর্যোগ মোকাবেলায় জান-জমানা খতম করে ফেলা দশাসইসব উন্নয়ন ফেরিওয়ালারা সেদিন হাঁ হয়ে তাকিয়েছিলেন আন্দামানের আদিবাসীদের দিকে। আসলে তারা আন্দামানের আদিবাসী জনগণের জ্ঞান ও জীবনের প্রতি সেদিন শ্রদ্ধায় নতজানু হননি। তারা আশ্চর্য হয়েছিলেন 'অসভ্য' ও 'ন্যাংটা' আদিবাসীদের পক্ষে কীভাবে এসব আয়ত্ত করা সম্ভব, তা ভেবে। কারণ তারা আন্দামানের আদিবাসী ও তথাকথিত আধুনিক নগরজীবনের তুলনামূলক বিচার করে ফেলেছিলেন। তারা যুগ থেকে যুগে লালন ও পালন করে চলেছেন এক ঐতিহাসিক বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নিপীড়নের গণিত। যা আদিবাসী জনগণকে বরাবরই 'অপর' ও দাবিয়ে রাখার জবরদস্তি করে। তা সে আন্দামানেই হোক আর বাংলাদেশেই হোক। তা সে জারোয়া হোক কী কোল বা ম্রো বা লালেং বা মুসহর বা মুণ্ডা, যা-ই হোক না কেন।
সম্প্রতি আবারও ভারতের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের জারোয়া আদিবাসী জনগণ তথাকথিত 'আধুনিক সভ্যতা'র খবরে পরিণত হয়েছে। ৫৭২টি দ্বীপ নিয়ে ভারতের আন্দামান-নিকোবর রাজ্য। ব্রিটিশ শাসনামলে ব্রিটিশবিরোধীদের এখানকার সেলুলার জেলে নির্বাসন দেওয়া হতো। সম্প্রতি পুলিশের সহায়তায় কিছু বহিরাগত পর্যটক আন্দামানের জারোয়াদের পূর্বানুমতি ও সম্মতি ছাড়াই তাদের নাচসহ অনেক কিছু ভিডিও করে, যা পরে ভারতের দিলি্লর টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হওয়ার পর নাগরিক বাহাস তুমুলে ওঠে। আন্দামানের দক্ষিণ-পশ্চিমে বসবাসকারী প্রায় ৪০০ জনসংখ্যার এই জারোয়ারা হয়তো তথাকথিত 'আধুনিক সভ্যতার' উপস্থাপনের রাজনীতি কী চিহ্নিতকরণের বিতর্ক সম্পর্কে জানে না। কিন্তু জারোয়া জনগণের ঐতিহাসিক শ্রেণীসম্পর্ক তছনছ করে বারবার তাদের এভাবেই 'উলঙ্গ এক আদিম বন্য উপজাতি' হিসেবে দেখানোর চল চলে আসছে ভারতে। ভারতের কেন্দ্রীয় আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রী ভি কিশোরচন্দ্র দেও, আন্দামানের সাংসদ বিষ্ণুপদ রায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমসহ অধিকারকর্মী, লেখক, গবেষক ও আদিবাসী জনগণ টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত আন্দামানের জারোয়াদের সাম্প্রতিক ফুটেজ এবং এর উপস্থাপনের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। বিষয়টি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেওয়া হয়েছে। আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের জারোয়াদের সাম্প্রতিক ভিডিওচিত্রের আলোচনার মূল জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে জারোয়াদের নিজস্ব পোশাকশৈলী ও কাপড় ব্যবহারের বিষয়টি। যেহেতু আন্দামানের অনেক আদিবাসীই নিজেদের মতো কাপড়বিহীন জীবনযাপন করে, যাকে আমরা 'নগ্নতা' হিসেবে পাঠ করে আসছি দিনের পর দিন প্রশ্নহীন কায়দায়। আমাদের ক্ষমতাধর পাঠ-পদ্ধতির এ বৈষম্যের গণিতই বারবার দুনিয়ার বন-পাহাড় কী দ্বীপে খুঁজে বেড়ায় 'ন্যাংটা-অসভ্য-মানুষখেকো-জংলি উপজাতিদের'। আন্দামানের জারোয়াদের এই ভিডিও কোনো নতুন ঘটনা নয়। এভাবেই লাল আদিবাসীদের দেশ লণ্ডভণ্ড করে, হত্যা, লুট ও ধর্ষণ করে কলম্বাস একদিন 'আমেরিকা' আবিষ্কার (!) করেছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশে আমরা যখন-তখন আদিবাসী বসতিতে ঢুকে পড়ি আমাদের ক্যামেরা আর গবেষণার ফর্দ নিয়ে। তুলে আনি কত জানা-অজানা ইতিহাস। শহরের এলিট শ্রেণী এসব তথ্য ও ছবি বিক্রি করে ভাত জোগাড় করে বলেই বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠান, কী গণমাধ্যম থেকে রাষ্ট্র, সবাই 'আদিবাসীদের এ অন্য উপস্থাপনের' পক্ষ নেয়; এ ধরনের উপস্থাপনকে নানাভাবে বৈধ ও নির্দিষ্ট করে। আন্দামানের জারোয়াদের এই সাম্প্রতিক উপস্থাপনও এর বাইরের কিছু নয়।
একটার পর একটা 'ন্যাংটা উপজাতি' আবিষ্কারের এ মহান নেশা আমরা বাংলাদেশেও বহাল রেখেছি। আন্দামানের জারোয়াদের নিয়ে সাম্প্রতিক এ অন্যায় উপস্থাপন নিয়ে আলাপ-বাহাস হচ্ছে। সরকার ও রাষ্ট্র জারোয়াদের পক্ষে গিয়ে উপস্থাপন-বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে বলছে। কিন্তু বাংলাদেশে কখনোই রাষ্ট্র আদিবাসী জনগণের এ ধরনের উপস্থাপনের বিরোধিতা করেনি; বরং আদিবাসী জনগণের এ অন্যায় নিপীড়নমূলক উপস্থাপনকে বারবার বৈধতা দিয়ে এসেছে। এখনও বান্দরবানের ম্রো জনগণের দিকে বাঙালি ক্যামেরাগিরি থামেনি। 'ন্যাংটা ম্রো নারীর গোসলের ছবি তোলা' আলোকচিত্রীদের এক চিরাচরিত অভ্যাস। ছবি তোলার জন্য মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ডে খাসি জনগণের বাঁশের বেড়ার গায়ে শত শত ফুটো করে ফেলেছিলেন বাঙালি পর্যটকরা। আর 'আদিবাসীদের' নিয়ে কী ছবি তোলা হয়, তার কী দেখানো ও ছাপানো হয়_ তার কম-বেশি হদিস আমাদের সবারই জানা। আদিবাসীদের ওপর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অন্যায়, বৈষম্য এবং নিপীড়নের কোনো মাত্রা ও ছাপ এসব ছবিতে থাকে না বলেই হয়তো রাষ্ট্র আদিবাসীদের এই তথাকথিত 'নগ্নতার' উপস্থাপনকেই বৈধ করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ম্রো জনগণের জীবন-সংগ্রাম নিয়ে আলোকচিত্রী মাহমুদের 'আং ইং ম্রু রুং' শীর্ষক প্রদর্শনীর কথা বলা যায়। যেখানে ম্রো জনগণ উপস্থাপিত হয়েছে এক অপরত্ব নির্মাণের 'নগ্নতার' রাজনীতির ভেতর দিয়েই।
আন্দামানের জারোয়া আদিবাসীদের সাম্প্রতিক ঘটনাটি আবারও আঙুল তুলে ধরেছে ক্ষমতায় টিকে থাকার বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি আর অন্যায় উপস্থাপনের দিকে। আদিবাসী জনগণের প্রতি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশেও বৈষম্য ও অন্যায় চূড়ান্ত কায়দায় বহাল রয়েছে। আন্দামানের জারোয়াদের জনসংখ্যা প্রায় ৪০০-এর মতো। এ ঘটনায় ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে ঘটনার নিন্দা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি হরহামেশাই বলে বেড়াচ্ছেন, দেশে কোনো 'আদিবাসী' নেই। আবার তিনি বলছেন, এত কম জনসংখ্যার জন্য সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠকে সমস্যায় ফেলতে পারে না। আদিবাসীবান্ধব ডা. দীপু মনির এ উপলব্ধি ও আচরণ কোনোভাবেই একজন ব্যক্তি দীপু মনির নয়। এটি রাষ্ট্রের ওই 'পররাষ্ট্রমন্ত্রী' পদটির বক্তব্য ও মনস্তত্ত্ব। তার মানে আমূল বদল ঘটাতে হবে রাষ্ট্রের ওই চেয়ার ও চরিত্রের। বৈষম্যের গণিত দিয়ে আর যাই হোক নিপীড়িত জনগণের দিনবদলের যোগ-বিয়োগ করা যায় না। আন্দামানের জারোয়া আদিবাসীদের নিয়ে সংঘটিত অন্যায়ের দ্রুত সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার প্রার্থনা করছি। পাশাপাশি আন্দামানের জারোয়াসহ দুনিয়ার সবপ্রান্তের আদিবাসী জনগণের ওপর সব ধরনের চিহ্নিতকরণ-উপস্থাপন ও বলপ্রয়োগ বন্ধের জোর দাবি জানাচ্ছি।
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে দেশের কোচ, হাজং, ডালু, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, মৈ তৈ মণিপুরী, লালেং, চাকমা, ত্রিপুরা, রাখাইন, ম্রাইনমা, খাসি, মান্দি, বানাই, খাড়িয়া, মাহালি, লুসাই, বাঙালি, বেদে-মাঙতা, ম্রো, পাংখো, বম, মুণ্ডা, লেঙাম, সাঁওতাল, ওঁরাও, ভূমিজ, দেশোয়ালি, কর্মকার, হদি, রাজবংশী, ক্ষত্রিয়বর্মণ, চাক, তঞ্চঙ্গ্যা, খুমি, খয়াং, কন্দ, কোল, কুর্মি, জৈন্তিয়া, মালো, কোড়া, মুসহর, রবিদাস, লোহার, বড়াইকসহ সব জনগোষ্ঠীর একক জাতীয়তার পরিচয় রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্ধারিত হয় বাঙালি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আবার দেশের আদিবাসী জনগণের পরিচয় হয় একাধারে বাঙালি, বাংলাদেশি, উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। আদিবাসী জনগণের জন্য 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০' চূড়ান্ত হলেও ওই আইনে আদিবাসী জনগণকে নিয়ে ভুল, মিথ্যা ও অন্যায় উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কোনো ধারা রাখা হয়নি। আশা করছি, আদিবাসীদের প্রতি সব বৈষম্য দূর হবে এবং সমূলে নিশ্চিহ্ন হবে আদিবাসী জনগণকে নিয়ে ক্ষমতাধর উপস্থাপনের 'নগ্নতার রাজনীতি'। ভারতের আন্দামানের জারোয়া কিংবা বাংলাদেশের আদিবাসীই হোক, সবার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রকে তা পালন করতেই হবে।

পাভেল পার্থ : গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ
animistbangla@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.