চরাচর-১২০ বছরে গৈলা স্কুল by আনোয়ার হোসেন

জ ২০১২ সালের ২৩ জানুয়ারি বরিশালের আগৈলঝাড়ার গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১২০তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ ক্রীড়াকক্ষে আয়োজন করা হয়েছে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের। গৈলা একটি ইউনিয়নের নাম। স্কুল, ডাকঘর, বাজার_সব কিছুর পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে গৈলা।


ঢাকায় রয়েছে গৈলা পরিষদ নামের একটি সংগঠন। ১৯৯৩ সালে বিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি সামনে রেখে ঢাকায় অবস্থানরত বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রছাত্রীরা শতবর্ষ ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তাঁরা নিজেরা অর্থ দিয়ে নির্মাণ করেন ১৬০০ বর্গফুট আয়তনের ভবন। বিপুলসংখ্যক সাবেক শিক্ষার্থীর পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভবনের উদ্বোধন করে যশোর শিক্ষা বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক হাসান ওয়াইজ বলেন, 'সাবেক শিক্ষার্থীদের এ ধরনের সম্মিলিত উদ্যোগ ব্যতিক্রম। অনেক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক কারণে কিংবা পরিবারের কারো স্মৃতি ধরে রাখার জন্য আর্থিক বা অন্য ধরনের সহায়তা দেওয়ার নজির রয়েছে; কিন্তু গৈলা স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থীরা যা করেছে, তা সবার স্বার্থে।' সাবেক শিক্ষার্থীদের আরেকটি কাজ মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান। ২০০১ সাল থেকে চালু রয়েছে পাঁচ লাখ টাকার সৈয়দ আবুল হোসেন ছাত্রবৃত্তি। প্রতিবছর তৃতীয় থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীকে এই তহবিল থেকে বৃত্তি দেওয়া হয়। মাধ্যমিক পরীক্ষায় যারা কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়, তারাও এ তহবিল থেকে বৃত্তি পায়। সম্প্রতি তথ্যসচিব হেদায়েতউল্লাহ আল মামুন বিদ্যালয়ে উপস্থিত থেকে একদল শিক্ষার্থীর হাতে বৃত্তির অর্থ তুলে দেন। গৈলা ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ফুল্লশ্রী গ্রামে জন্মেছিলেন মনসা মঙ্গলের কবি বিজয় গুপ্ত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মনসা মন্দির ৫০০ বছরের পুরনো। ২০০৪ সালে মন্দিরে স্থাপিত হয়েছে প্রায় এক টন ওজনের পিতলের মনসামূর্তি। এখন মন্দিরটিও আকর্ষণীয় নকশায় নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। মন্দিরে নিয়মিত আয়োজিত হয় রয়ানি পালা। শিল্পীদের বেহুলা-সোনেকার বিলাপ শুনে শ্রোতারা হয়ে ওঠে অশ্রুসিক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের কৃতী ছাত্র অমিয় দাশগুপ্ত গৈলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন, যাঁর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচয় 'অর্থনীতিবিদদের অর্থনীতিবিদ' হিসেবে। তিনি নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্র্ত্য সেনের পিএইচডি রিসার্চ গাইড ছিলেন। অমর্ত্য সেন লিখেছেন, "মাস্টারমশাই (অমিয় দাশগুপ্ত) সব সময় বলতেন, 'আমার জীবনে যা কিছু অর্জন, তার মূলে গৈলা স্কুল'।" গৈলা স্কুল থেকে যাঁরা দশকের পর দশক ধরে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে চলেছেন, তাঁরা একইভাবে বলতে পারেন, গৈলা স্কুলই আমাদের গড়ে তুলেছে। জীবনসংগ্রামে সফল হতে প্রেরণা জুগিয়ে চলেছে। স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক কৈলাশ চন্দ্র সেন। উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরির মায়া তিনি ত্যাগ করেছিলেন প্রত্যন্ত গ্রামে একটি স্কুল গড়ে তোলার জন্য। তবে এখানেই থেমে থাকেননি। গৈলা স্কুল পরিচালনার পাশাপাশি তিনি পাশের গ্রাম আগৈলঝাড়ায় ভেগাই হালদার পাবলিক একাডেমী গড়ে তোলায় উদ্যোগী ভূমিকা রাখেন। এ কারণেই তাঁর ওপর ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়েছিল। কৈলাশ চন্দ্র সেনের সমাধিসৌধে একটিই বাক্য_ডেথ ডিভাইড, মেমোরি লিঙ্গারস। সত্যিই, স্মৃতি টিকে থাকে কর্মগুণে। তাঁর জীবনাবসান ঘটেছে প্রায় সাত দশক। কিন্তু এখনো স্কুলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা দল বেঁধে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানান। গৈলা পরিষদের সদস্যরা প্রতিবছর রাজধানীর আশপাশে পুনর্মিলনীর আয়োজন করেন। এভাবে তাঁরা বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিজেদের সংশ্লিষ্টতা বাড়ানোর এবং সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পান। বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের সাবেক মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও সুনীল গুপ্ত, সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম এ মালেক, বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্য সৈয়দ আবুল হোসেন এবং সচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার। স্কুলের শতবর্ষ উপলক্ষে সাবেক শিক্ষার্থীরা শতবর্ষ ভবন নির্মাণ করেছিলেন। আরেক স্মরণীয় উপলক্ষ ১২০তম বার্ষিকী তাঁরা কিভাবে স্মরণীয় করে রাখেন, তা নিয়ে অধীর আগ্রহ থাকবেই। দেশ-বিদেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী দক্ষতা ও সৃজনক্ষমতা উজাড় করে দিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁদের স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল গৈলার স্কুলটি। এ স্মৃতি ভোলার নয়।
আনোয়ার হোসেন

No comments

Powered by Blogger.