নিরাপদ সড়ক-দায়িত্বশীলদের শুভবুদ্ধি হোক

দেশে 'ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো'র লোক ক'জন আছেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিশেষ গবেষণার প্রয়োজন হয় না। পত্রপত্রিকার মাধ্যমে খুব অল্প মানুষের কথাই জানা যায়। এদের মধ্যে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের নাম প্রথম সারিতে আসে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে যে বাংলা সিনেমাটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যবসাসফল বলে গণ্য সেই 'বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না'র নায়ক তিনি।


আরও বহু জনপ্রিয় সিনেমায় অভিনয় করেছেন, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নাগরিক আন্দোলনে তার ভূমিকার কারণে তিনি নায়কের পরিচয় ছাপিয়ে একজন অ্যাক্টিভিস্টের পরিচয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। ১৯৯৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী বিয়োগের পর তিনি নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। ১৮ বছরের তৎপরতায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অপর নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে ইলিয়াস কাঞ্চন। দেশের সড়ক নিরাপদ হয়নি এতদিনে, বরং প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে নাগরিকরা। মিরসরাই ট্র্যাজেডির পর তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীরের মতো প্রতিভাবান ব্যক্তির মৃত্যুর পর এ বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। ইলিয়াস কাঞ্চনের একার আন্দোলন এখন বহুজনের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। সাধারণের মধ্যে এ উপলব্ধি এখন স্পষ্ট যে, আইনের শিথিল প্রয়োগ, চালকের প্রশিক্ষণের অভাব তথা অশিক্ষা, রাস্তাঘাটের বেহাল দশাই দুর্ঘটনার মূল কারণ। কিন্তু এগুলোর বিহিত করার উদ্যোগ এ যাবৎ কেউ নেয়নি। এখন নাগরিক দাবির মুখে কিছু দাবি পূরণের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, এ দেশে এমন মানুষও আছেন যারা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী উপাদানগুলোর পক্ষাবলম্বন করতে পারেন। চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতাহীনতা ও প্রশিক্ষণহীনতার পক্ষে সাফাই গাইতে পারেন। এমনকি দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিরোধিতাও এ দেশে সম্ভব। তারও চেয়ে বড় বিস্ময় হলো, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো অরাজনৈতিক ও কল্যাণমূলক আন্দোলনের নেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিতে জুতা মারার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও এ দেশে ঘটতে পারে! ২৪ অক্টোবর শহীদ মিনারে সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের মহাসমাবেশে একজন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে এমন ঘটনা ঘটেছে। পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সর্বস্তরের নাগরিকরা এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা যেদিন শহীদ মিনারে সমাবেশ করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবিকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে, আন্দোলনকারীদের অপমান করে তাদের থামিয়ে দিতে চেয়েছে, সেদিনও চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে মর্মান্তিক দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় তিন শিক্ষার্থীর প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তিনজনই এসএসসি পরীক্ষার্থী। তিনজনের সামনেই ছিল ভবিষ্যতের অমিত সম্ভাবনা। কিন্তু চালকদের হঠকারিতায় এদের প্রাণ গেল। প্রশ্ন হলো, আইন অমান্য করে বেপরোয়া গাড়ি চালনার জন্য চালকরা দায়ী হবেন না কেন? তাদের রোখার জন্য এত আন্দোলনের প্রয়োজন হবে কেন? কেনই-বা সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা তাদের পক্ষে সাফাই গাইতে মাঠে নামবেন? গত ২২ অক্টোবর ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বে শহীদ মিনারেই প্রতীকী গণঅনশন হয়েছে। সেখানে সড়ক বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী উপস্থিত হয়ে আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের অনশন ভঙ্গ করিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, এ ঘটনার পরদিন সেই আন্দোলনের নেতার ছবিকে অপমান করার ঘটনা ঘটবে কেন? নাগরিকরা আশা করে, নিরাপদ সড়ক দাবির আন্দোলনের প্রতি সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সহানুভূতিশীল হবেন। সড়ক দুর্ঘটনা রোধের জন্য প্রয়োজনীয় আইন করা হোক, সঙ্গে আইনের বাস্তবায়নও নিশ্চিত করা হবে। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর অবস্থানই নাগরিকরা আশা করে। এ বিষয়টি সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন ততই মঙ্গল।
 

No comments

Powered by Blogger.