প্রতিক্রিয়া-আক্রান্ত পরিবারের সুবিচার পাওয়ার অধিকার by তৌহীদ রেজা নূর

‘অপরাধের প্রতিকার ও অভিযুক্তদের ন্যায্যবিচার’ শীর্ষক ডেভিড বার্গম্যানের লেখাটি গত ২২ নভেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তাঁর লেখাটি শুরু হয়েছে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার বাবা এ দেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের অপহূত হওয়ার বিষয় অবতারণার মাধ্যমে। সম্ভবত ভুলক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে যে ঘাতকেরা তাঁকে তাঁর মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে অপহরণ করতে আসে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি অপহূত হন ঢাকার চামেলীবাগ এলাকা থেকে।


লেখাটির শিরোনাম থেকে এটি স্পষ্ট যে, লেখক ‘অপরাধের প্রতিকার’ করার প্রক্রিয়ায় ‘অভিযুক্তদের ন্যায্যবিচার’-এর বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পুরো লেখার মূল কথা, ‘সুষ্ঠু বিচারের উচ্চ মান’ নিশ্চিত করা এবং ‘আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের যথাযথ বন্দোবস্ত’ করা, যা নিঃসন্দেহে যেকোনো আইনি প্রক্রিয়ার পূর্বশর্ত। লেখক তাঁর লেখার মূল বার্তা পাঠকের সামনে মেলে ধরতে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বেশ কিছু প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছেন, যা সহজ করে বললে এ রকম—
প্রথমত, ঘটনা (অপরাধ) সংঘটিত হওয়ার প্রায় ৪০ বছর পরে এই আনুষ্ঠানিক বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ও প্রামাণিক দলিলপত্র পাওয়া যাবে কি না, কিংবা সাক্ষী পাওয়া গেলেও বিচার্য বিষয়টি অনেক আগে সংঘটিত হওয়ার কারণে তাঁরা সংগতিপূর্ণ সাক্ষ্য দিতে পারবেন কি না। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধাপরাধ যে দেশে ঘটেছে, বিশেষ করে ১৯৭১ সালে যে মাত্রায় অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে, সেই দেশে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা ঠিক সিদ্ধান্ত কি না। কারণ তিনি মনে করেন, এই অপরাধের বিষয়ে বাংলাদেশে যে আবেগ রয়েছে, তা থেকে বিচারকেরাও মুক্ত নন, ফলে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে বিচারকার্য সুসম্পন্ন করা একটি চ্যালেঞ্জ। তাই বিচারিক প্রক্রিয়ায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য ‘আত্মপক্ষ সমর্থনের সঠিক পদ্ধতিগত কাঠামো অনুসরণ’ করার সুযোগ নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন মি. বার্গম্যান। তৃতীয়ত, জাতিসংঘের বিচারক বা জাতিসংঘের সহযোগিতা ছাড়া এটি প্রথম জাতীয় ট্রাইব্যুনাল, তাই এই বিচারকাজ সুষ্ঠুভাবে হওয়া জরুরি, যাতে আগামী দিনের যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়ায় এটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। চতুর্থত, এই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষেরা, যারা জানে না—জানতে পারবে বাংলাদেশে কী হয়েছিল ১৯৭১ সালে; তাই সুষ্ঠু বিচারপ্রক্রিয়া অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। পঞ্চমত, বর্তমানে আটক সবাই বিরোধী দলের। ফলে এই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সরকার যেকোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করছে না, তা প্রমাণের একমাত্র উপায় সুষ্ঠু বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, যা আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের যথাযথ সুযোগ দেবে।
ডেভিড বার্গম্যানের উদ্বেগের ঝাঁপিতে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের ‘মানবাধিকার’-এর বিষয়টি দারুণ গুরুত্ব লাভ করলেও ভুক্তভোগী বা আক্রান্ত পরিবারের বেঁচে থাকা সদস্যদের ন্যায্যবিচার পাওয়ার প্রশ্নটি উপেক্ষিত থেকেছে, যা আমাদের তথা আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না এবং তাঁর লেখায় আলোচিত বিষয়গুলো আরও কিছু বাঞ্ছনীয় বিষয় নিয়ে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে।
বিশেষ ট্রাইব্যুনালের আওতায় মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষী ও প্রামাণিক দলিলপত্রের বিষয়গুলো কি ফৌজদারি মামলার মতো একই রকমভাবে বিবেচিত হয়, নাকি পার্থক্য রয়েছে? এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে এমন কিছু মানুষের বিচার করতে, যাদের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মূলত নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীকে (এ ক্ষেত্রে মুক্তিকামী বাঙালি) নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে ধারাবাহিক হত্যাযজ্ঞ ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের উদ্দেশ্যে গঠিত এই ট্রাইব্যুনাল নিশ্চয় তদানীন্তন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিচার-বিশ্লেষণ করে, যথাযথ প্রমাণাদির আলোকে তাদের রায় দেবেন। অজপাড়াগাঁ বা শহর-নগরের কোনো নাম না-জানা অথবা সবার চেনা জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী বা আক্রান্ত পরিবারের সদস্যের জবানবন্দি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ১৯৭১ সালকে নিয়ে ভিনদেশের নামকরা মানুষের (যেমন—সাইমন ড্রিং, মার্কটালি, রবিশংকর, আদ্রেঁ মালরো প্রমুখ) সাক্ষ্য, লেখা, চিঠি, আলোকচিত্র, চলমানচিত্র ও অন্যান্য নিদর্শন। সর্বোপরি ১৯৭১ সালের দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা (দেশের ও বিদেশের) সে সময়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য বহন করছে, যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মতাদর্শ ও কর্মকাণ্ডের স্বরূপ সুস্পষ্টভাবে অঙ্কিত রয়েছে। তাই মনে করি, এই বিচারপ্রক্রিয়ায় স্মৃতিনির্ভর সাক্ষ্য গ্রহণই একমাত্র বিবেচ্য হবে না।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। বোধগম্য কারণে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে এই বিচারপ্রক্রিয়া এবং অন্য কোনো দেশে তা হওয়ার কোনো কারণই নেই। তবুও মি. বার্গম্যানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে যদি মেনে নিই যে নিরপেক্ষতার স্বার্থে এ প্রক্রিয়া বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশে আরম্ভ হওয়া উচিত ছিল, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, ‘কোন সে দেশে?’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে তো পৃথিবী বিভাজিত হয়েছিল, কোন কোন দেশ আমাদের পক্ষে, কোন কোন দেশ আমাদের বিপক্ষে ছিল—তাহলে সর্বজনগ্রাহ্য দেশ কোনিট? কে এবং কীভাবে নির্বাচিত করবে ‘সর্বসম্মত’ সেই দেশ?
ধরা যাক, শেষ পর্যন্ত কোনো দেশ নির্বাচিত হলো। এখন সেই দেশে এ বিচারকাজ করতে হলে কিছু জরুরি বিষয় বিবেচনায় রাখা দরকার, যা সহজে বাস্তবায়নযোগ্য নয়। যেমন, সাক্ষী, অভিযুক্ত ও নির্বাচিত আইনজ্ঞ বা আইনজীবীদের ভিনদেশের বিচারালয়ে হাজির করার জন্য যাতায়াতের ব্যবস্থা, সাক্ষী নির্বাচনপ্রক্রিয়া, জবানবন্দি গ্রহণে ভাষা জটিলতা ও তাদের সবার নিরাপত্তা বিধান ইত্যাদি। সর্বোপরি, সামগ্রিক প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে সীমাহীন ব্যয় বহনের বিষয়টি ভাবনার মধ্যে এনে মি. বার্গম্যানের মতো যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা অন্য দেশে এই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করার দুর্ভাবনা থেকে সরে আসবেন আশা করি।
ডেভিড বলেছেন, ‘নিরপেক্ষতা বজায় রেখে বিচারকার্য সুসম্পন্ন করা একটি চ্যালেঞ্জ।’ খুবই সত্য, কিন্তু তা শুধু এই বিচারপ্রক্রিয়ার জন্য নয়, বিষয়টি সত্য স্থান-কাল-পাত্র-নির্বিশেষে সব বিচারপ্রক্রিয়ার জন্য এবং সে বিষয় বিবেচনায় রেখেই যুগে যুগে বিচারপ্রক্রিয়া পৃথিবীব্যাপী চালু রয়েছে। সুচারুভাবে কাজ সম্পন্ন করতে বিদ্যমান ট্রাইব্যুনাল নিশ্চয় আমাদের দেশের অন্যান্য আইনজীবী, যাঁদের ভিন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাঁদেরও এই ট্রাইব্যুনালে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত করছেন বা করবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করতে যাঁরা বসবেন, তাঁদের ১৯৭১ সাল তৈরি হওয়ার আনুপূর্বিক ঘটনা অনুধাবন ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা থাকতে হবে, এবং সামগ্রিক বিচারপ্রক্রিয়া বিবেচনায় রেখে বিজ্ঞ আদালত রায় ঘোষণা করবেন। এবং শুধু অভিযুক্ত ব্যক্তির ন্যায্যবিচার পাওয়ার অধিকার সুনিশ্চিত করা নয়, আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের সুবিচার পাওয়ার অধিকার সমুন্নত রাখতে এই ট্রাইব্যুনাল নিশ্চয় ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখবে।
এই ট্রাইব্যুনাল গঠন কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়; এটি শহীদ পরিবার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন মানুষের দীর্ঘদিনের দাবির ফসল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর থেকেই শহীদ পরিবার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন এ দেশবাসী মানবেতিহাসের এই বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের বিচার দাবি করে আসছে। বঙ্গবন্ধুর সরকার এর উদ্যোগও নিয়েছিল। কিন্তু কে না জানে স্বাধীন বাংলাদেশে নানা অজুহাতে মুক্তিযুদ্ধপক্ষ শক্তির বিভাজন ও ১৯৭১ সালে পরাজিত হওয়া সেই অপশক্তির পুনরুত্থানের গল্পই আমাদের বিগত ৪০ বছরের ইতিহাস।
জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্রের আহ্বান মূলত এ দেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসনের কৌশলমাত্র। তাঁর আমলে এ দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন শাহ আজিজুর রহমান, যিনি একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চরম বিরোধিতা করে জাতিসংঘে বক্তব্য প্রদান করেছিলেন; জিয়াউর রহমানের বদৌলতে জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযম, যুদ্ধাপরাধের জন্য যাঁর বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়—বহাল তবিয়তে বাংলাদেশে ফিরে এসে পুনরায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু করেন।
পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর একাদিক্রমে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মূলত সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অঙ্গুলি হেলনে দেশ পরিচালিত হয়। তরুণ মনে প্রোথিত করা হয় এক অদ্ভুত বিভ্রান্তিকর তথ্যের তরুমূল, যা ক্রমেই শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে সমাজের এক বিরাট অংশকে গ্রাস করতে সমর্থ হয়েছে। নির্বাসিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনরায় তারুণ্যের মনে জাগ্রত করার আন্দোলন শুরু হয় ১৯৯১ সালে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম নেতৃত্ব দেন সেই আন্দোলনের। তারই ধারাবাহিকতায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির পক্ষে বাংলাদেশের আজকের তরুণের মতপ্রকাশ এক ইতিবাচক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত প্রদান করে।
আশা করি, ডেভিড বার্গম্যানেরা অযথা বিভ্রান্তিমূলক প্রশ্ন না তুলে একাত্তরের মানবতাবাদবিরোধী ব্যক্তিদের বিচারকাজে সহায়তা করবেন, বুঝতে চেষ্টা করবেন, এত দিন এদের বিচার না হওয়ায় যে কলঙ্ক জাতির ওপর চেপে বসেছে, তা থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে হবে, নইলে এই ব্যর্থতার দায়ভার আমাদের সবার ওপরই পড়বে।
তৌহীদ রেজা নূর: সাংবাদিক এবং শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র।

No comments

Powered by Blogger.