ফার্স্ট ইয়ার অথবা নিছক ‘ত্যাল’

মি তখন একেবারে গ্যাদা, মাত্র কলেজে উঠেছি, কলেজের নাম শরীয়তপুর সরকারি কলেজ। আমাদের ফার্স্ব ইয়ারের ক্লাস প্রথম যেদিন শুরু, সেদিনই আমি ১০ মিনিট দেরি করে কলেজে পৌঁছলাম। পৌঁছেই একেবারে হুড়মুড় করে আমার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড (পড়ুন বন্ধু) হাবিব আর আমি ক্লাসে ঢুকে গোবেচারার মতো পেছন দিকে বসে রইলাম।


শ্রেণীশিক্ষক আমাদের দিকে কিছুক্ষণ এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন যে, মনে হলো তাঁর ক্লাসে দুুটি এলিয়েন এসে বসে আছে! হঠাৎই স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই যে নবাব সিরাজউদ্দৌলা, পলাশীর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বলেন।’ প্রথম কথা হচ্ছে, আমার নাম নবাব কিংবা সিরাজউদ্দৌলার কোনোটিই নয়। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমি ভর্তি হয়েছি ব্যবসায় শাখায়, এখানে তো পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে কোনো কচকচানি নেই। তাহলে? স্যারের নিশ্চয়ই ভুল হচ্ছে। স্যারের ভুলটা ধরিয়ে দেব কি না ভাবছি, ঠিক এমন সময় স্যার বললেন, ‘পারেন না, তাই না? কলেজে ফার্স্ট ইয়ার আসছে, তাই শরীরের “ত্যাল” বাইড়া গেছে, না? আসেন, “ত্যাল” কমাইয়া দেই...।’
এরপর স্যার বেশ খানিকটা সময় নিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আমাদের দুজনের ‘ত্যাল’ কমিয়ে দিলেন। কীভাবে কমালেন সেটা বলে দেব, এতটা বোকা আবার আমি না। শুধু ‘ত্যাল’ কমানো শেষে যখন স্যার ক্লাস থেকে বের করে দিচ্ছিলেন, তখন চোখ গেল স্যারের হাতে থাকা বইটার দিকে। বইয়ে লেখা ‘প্রাচীন বাংলার ইতিহাস’ । এবার বুঝতে পারলাম, বন্ধুরা কেন আমাকে ‘টিউবলাইট’ বলে।
প্রথম ক্লাসে এভাবে অহেতুক ‘ত্যাল’ কমানোর পর আমরা দ্বিতীয় ক্লাস অনেক সাবধানতার সঙ্গে খুঁজে বের করলাম। না, এবার আর কোনো ভুল নয়, এটাই আমাদের ক্লাস। ক্লাস যখন শুরু হবে হবে করছে, ঠিক এ সময় জনা দশেক বড় ভাইয়া ক্লাসে ঢুকলেন। ঢুকেই ঘোষণা দিলেন, ক্লাস বন্ধ। ছাত্রছাত্রীদের কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে তাঁরা আন্দোলন করছেন। এখন তাঁদের সঙ্গে আমাদের আন্দোলনে যেতে হবে। সুতরাং কোনো ক্লাস হবে না। বড় ভাইদের চোখ এড়িয়ে আমরা কোনোমতে বেরিয়ে এলাম। কলেজের পুকুরপাড়ে বসে শ্রদ্ধেয় বড় ভাইদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছিলাম। আমি মনে হয় একটু জোরেই তাঁদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ফেলেছিলাম। একটা আপু টাইপের মেয়ে আমাদের কাছে ছুটে এল। আমাকে বলল, ‘কী ব্যাপার, তোমরা মিছিলে যাওনি?’ ‘যাইনি তা তো দেখতেই পাচ্ছেন।’
আপুটা কেমন করে যেন হাসছে, আমাকে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘যাওনি কেন?’ আমি কঠিন কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। শেষ মুহূর্তে কোনোমতে বললাম, ‘যাইনি, কারণ আমাদের শরীরে অত ত্যাল নাই যে মিছিলে গিয়ে কমিয়ে আসব। আর আপনি এখন বিদায়, সামনে থেকে সরেন।
আপুটা চলে গেল কিন্তু আবার ফিরে এল। বলল, ‘শেষ প্রশ্ন, তোমরা কি ইন্টারে?’
আজব! এই মেয়ে বলে কী? ছেলে ও মেয়েদের উভয়েরই ব্রেন থাকা সত্ত্বেও কিছু সংখ্যক ছেলেমেয়ে কেন এত গাধা টাইপের হয়, কে জানে! আমি এবার কিছুটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জবাব দিলাম, ‘না, আমরা ফার্স্ট ইয়ারে!’
(আমাকে দোষ দেবেন না, আমি তখন সত্যিই জানতাম না, যাহা ইন্টার, তাহাই ফার্স্ট ইয়ার)
আমার উত্তর শুনে আপুটা এমনভাবে হাসতে লাগল যে মনে হলো, তার দাঁতের নিচে হাসির কিছু পড়েছে!
দেখুন, ঘটনাটা যদি এখানেই শেষ হতো, তাহলে আমার কোনো আপত্তি থাকত না। আরও কিছু দূর গড়াল। পরদিন প্রথমেই ছিল ব্যবস্থাপনা ক্লাস। ক্লাসে যখন ম্যাডাম প্রবেশ করলেন, তখন আমার মনে হলো—পুরাণের মতো যদি সত্যি সত্যি মাটি দ্বিখণ্ডিত হওয়ার কোনো উপায় থাকত, তাহলে মন্দ হতো না! ম্যাডাম রোলকল শেষ করে একবারও আমার দিকে না তাকিয়ে (ইচ্ছে করেই) বললেন, ‘শোনো, এটা হচ্ছে ইন্টারের ক্লাস, তবে তোমরা যারা ফার্স্ট ইয়ারে আছো, চাইলে তারাও ক্লাস করতে পারবে। আর কারও শরীরে “ত্যাল” না থাকলে তাকে ক্লাস করতে হবে না।’ বুঝুন ঠেলা, কেমন লাগে?
 আশিস মণ্ডল
ডিপার্টমেন্ট অব ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.