পরিবেশ-যত দোষ ‘জলবায়ু ঘোষ’ by পাভেল পার্থ

লতি দুনিয়ায় প্রশ্নহীন কায়দায়, অনেক সময় প্রায় জোর খাটিয়ে, ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ প্রত্যয়টিকে সবকিছুর সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার একটা যাচ্ছেতাই চল তৈরি হয়েছে। নয়া উদারবাদী বৈশ্বিক ব্যবস্থার মুমূর্ষু সংকটময় রূপটিকে ঢাকতে অন্য সব দেনদরবার পাশ কাটিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের তকমা এঁটে সবকিছুকে ঢাকার তোড়জোড় চলছে।


এখানে আড়াল করে ফেলা হচ্ছে উত্তর-দক্ষিণের ক্ষমতার রাজনীতি, উন্নত বিশ্বের ভোগবাদী অন্যায় শাসন আর নিপীড়িত তৃতীয় দুনিয়ার নিরন্তর প্রতিরোধের মহাবয়ান। এ যেন বাংলা প্রবাদের সেই ‘নন্দ ঘোষ’-এর আরেক সমসাময়িক রূপ। দুধে জল মেশালেও নন্দ ঘোষ, পাড়ায় কারোর গাছের একটা আম খোয়া গেলেও নন্দ ঘোষ, বৃষ্টিজলে রাস্তায় কাদা হলেও নন্দ ঘোষ, গরুর লেজের বাড়ি খেয়ে মাছি মরলেও নন্দ ঘোষ। এককালের গ্রামীণ বাংলার নন্দ ঘোষের ওপরই চাপিয়ে দেওয়া হতো যাবতীয় দোষের ভাঁড়। একালে জলবায়ুর ঐতিহাসিক সীমানাকেই আরেক নন্দ ঘোষ বানিয়ে তোলার যারপরনাই চেষ্টা চলছে। বৈশ্বিক রাজনীতির দেনদরবার থেকে শুরু করে, দেশের রাজনৈতিক পরিসর, বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষজ্ঞ মহল, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এমনকি আমাদের গণমাধ্যম পর্যন্ত চলতি সময়ে যেকোনো কিছুর পেছনেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আবিষ্কার করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বাঁধ দিয়ে নদী আটকে ফেলা হয়েছে বা প্রভাবশালী নেতারা নদী দখল করে মুনাফা লুটছেন, সেই নদীর দুরবস্থার জন্যও দায়ী করা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনকে। জঙ্গল বিনাশ করে গড়ে তোলা হচ্ছে কারখানা, সেই বনহ্রাসের জন্যও দায়ী হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। বহুজাতিক রাসায়নিক বিষে মরছে জমির শামুক কি কেঁচো, প্রতিদিন জান দিচ্ছে অগণিত দেশি মৎস্য, তার দোষও পড়ছে জলবায়ুর ঘাড়ে। হাওরাঞ্চল ইজারা নিয়ে করা হচ্ছে বাণিজ্যিক মাছের খামার, বিষটোপ দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে পরিযায়ী পাখি, সেই দোষও জলবায়ু পরিবর্তনকেই মাথা পেতে নিতে হচ্ছে।
পরিবেশ ও প্রতিবেশগতভাবে ক্ষতবিক্ষত শরীর এবং প্রাণ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের বাংলাদেশ আজ করুণ রক্তক্ষরণের ভেতর দিয়ে পাড়ি দিচ্ছে বিজয়ের ৪০ বছর। সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য, লুটেরা রাজনীতি, দুর্বৃত্ত ক্ষমতায়ন, জনবিচ্ছিন্ন আমলাতান্ত্রিকতা আর করপোরেট উপনিবেশ বাংলাদেশকে আজ দাঁড় করিয়ে রেখেছে এক টালমাটাল দুর্দশা আর ক্ষতের ভেতর। আজ বৈশ্বিক জলবায়ু-পরিবর্তনের ফলে অন্যায়ভাবে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বের কাছে তার জলবায়ু-ন্যায়বিচার দাবি করছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই বাংলাদেশকে কোনোভাবেই ভুলে গেলে চলবে না যে সে তার নিজের দেশের প্রতিবেশ ও পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে বরাবর অন্যায় ও উত্তরের ধনী দেশের মতোই বৈরী আচরণ বহাল রেখেছে। বিশ্ব যেমন তার নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার ব্যর্থতা ঢাকতে সব দোষ চাপাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঘাড়ে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশও তার অভ্যন্তরীণ প্রতিবেশীয় সমস্যা ও বৈষম্য মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে সব দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের আজকের নন্দ ঘোষের ঘাড়ে। সাম্প্রতিক জলবায়ু বিপর্যয়ের মতো বৈশ্বিক ঘটনা মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশকে প্রথমেই তার নিজস্ব প্রতিবেশ-দর্শন ও রাজনৈতিক কৌশল স্পষ্ট করতে হবে। আর এর জন্য জরুরি দেশের সব অঞ্চল ও সংস্কৃতির জনজীবনের এক বিশাল জনমত ও অংশগ্রহণ।
দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল সেনাক্যাম্পের মাধ্যমে অধিগ্রহণ অব্যাহত রেখে বদলে দেওয়া হচ্ছে পার্বত্য বাস্তুসংস্থান। স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্যের পক্ষে বাজনা বাজিয়ে রাষ্ট্র এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ নানা দাতা সংস্থার পরামর্শে অকারণে দেশে টেনে আনছে একাশিয়া, ইউক্যালিপটাস, ম্যাঞ্জিয়ামের মতো আগ্রাসী গাছ। কেবল জাতীয় মৎস্য সপ্তাহে দেশি মাছের পক্ষে রাষ্ট্রীয় প্রচারণা থাকলেও সিলভারকার্প, নাইলোটিকার মতো আগ্রাসী মাছের জন্যই রাষ্ট্রের সকল উন্নয়ন খাতের দরজা খোলা থাকছে। সব দোষ অযথা জলবায়ু-পরিবর্তনের ঘাড়ে না চাপিয়ে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য প্রথম জরুরি কাজ হবে দেশের দুর্গত মানুষের দুর্যোগ মোকাবিলার লড়াইয়ে শামিল হওয়া। যেখান থেকে শিক্ষা ও সাহস নিয়ে বাংলাদেশ বৈশ্বিক জলবায়ু-দেনদরবারে নিজের অবস্থানকে আরও বেশি দৃঢ় ও ন্যায্য করে তুলতে পারে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি বিদ্যায়তনিক পরিসর, রাজনৈতিক মঞ্চ, বিশেষজ্ঞ, নীতিনির্ধারক ও গণমাধ্যমকেও দেশের স্থানীয় দুর্যোগ ও দুর্দশার সঠিক কার্যকারণ হদিসে আরও বেশি যৌক্তিক ও ন্যায়পরায়ণ হওয়া জরুরি।
দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু-পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজন তহবিলের পাশাপাশি এবার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লোকসান ও ক্ষতির বিষয়েও একটি তহবিল গঠন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জলবায়ু-পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশও মুখিয়ে আছে বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিলের দিকে। গভীর পানির ধানজাতসহ লবণপানি ও খরাপ্রতিরোধী জাত উন্নয়নের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার স্বপ্ন বাংলাদেশও দেখছে। কিন্তু বাংলাদেশকে কোনোভাবেই ভুলে গেলে চলবে না যে বাংলাদেশের হবিগঞ্জের নাগুড়াতেই উপমহাদেশের প্রথম গভীর পানির ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয়েছিল। দেশে লবণপানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বরেন্দ্রবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সবই আছে। দেশকে ৩০টি কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলে ভাগ করে প্রতিটি অঞ্চল অনুযায়ী কৃষিকর্মসূচি গ্রহণের সিদ্ধান্তও নিয়েছিল বাংলাদেশ। পাশাপাশি আছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইন, নীতি ও পরিকল্পনা। কিন্তু জনগণ এসবের কোনো সুফল ভোগ করতে পারেনি দীর্ঘ ৪০ বছরে। রাষ্ট্রের বিগত গবেষণা কর্মসূচি ও উন্নয়ন পরিকল্পনাসমূহের বিস্তারিত পর্যালোচনা ও যাচাই না করে কোনোভাবেই কেবল ‘জলবায়ু-তহবিল’ খরচ করার জন্য বাংলাদেশকে উন্মত্ত হলে চলবে না। কারণ এতে করপোরেট খবরদারি ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লাগাম দেশের ওপর আরও বেশি চেপে বসতে পারে। স্থানীয় প্রতিবেশ ও পরিবেশগত দুর্দশা মোকাবিলা করার পাশাপাশি আশা করি বাংলাদেশ নিজের যোগ্যতা, মত, দর্শন ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় নিজেই দেশের জনগণের জলবায়ু-ন্যায়বিচার সুরক্ষায় সত্যিকারের পদক্ষেপ নেবে।
পাভেল পার্থ: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ।
animistbangla@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.