ভোটারদের রায় মাইলফলক হতে পারে-নাসিক নির্বাচন by বদিউর রহমান

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) নির্বাচন এবার রাজনীতিতে একটা নতুন মাইলফলক হতে পারে মর্মে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং নির্বাচনে আগ্রহী অনেকের ধারণা। আমিও এর সঙ্গে একমত পোষণ করি। আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী এবং বিএনপির একজন হওয়ায় বিষয়টা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সমর্থনের নাটকে। স্থানীয় নির্বাচন হিসেবে স্বীকৃতভাবে দলীয় সমর্থন প্রকাশ্যে


হওয়ার কোনো সুযোগ আইনি দৃষ্টিতে নেই বটে, কিন্তু এ জন্য তো আর কোনো দল থেমে থাকে না। আওয়ামী লীগও নাসিক নির্বাচনে সেই কৌশলই হয়তো ঠিক করেছিল, দু'প্রার্থীকে সমঝোতায় আনার চেষ্টা করে একক প্রার্থী দিয়ে দু'দিকই রক্ষা করতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী-রাজনীতির কিছুটা হলেও দেউলিয়াত্ব আরেকবার প্রমাণ হয়েছে এ নাসিক নির্বাচনে একক প্রার্থী ঠিক করার ব্যর্থতায়। দু'কারণে এ দেউলিয়াত্ব প্রকাশ্য হয়েছে বলা চলে_ এক. স্থানীয় নির্বাচন হলেও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের এ নির্বাচন রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার জন্য নারায়ণগঞ্জ দলের হাতে থাকা প্রয়োজন; দুই. দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের জন্য এ নির্বাচন আওয়ামী লীগ তথা সরকারের নিরপেক্ষতার একটা মানদণ্ড হবে। বিবেচনায় সুস্থির সিদ্ধান্তের প্রয়োজন থাকলেও এ দল তাতে ব্যর্থ হয়েছে। শামীম ওসমান এবং ডা. আইভী ভাবমূর্তির দিক থেকে সাধারণ্যের বিবেচনায় হয়তো বিপরীতমুখী, কিন্তু এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দু'জনই প্রভাবশালী এবং স্বনামধন্য। আওয়ামী লীগ যদি ভোটারদের মনমানসিকতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হতো তাহলে সাধারণ মানুষ এবং নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা অবশ্যই খুশি হতেন। পেশিশক্তির মহড়া, মাস্তানি-সন্ত্রাস আমাদের রাজনীতিতে হয়তো এখনও একটা বড় ভূমিকা পালন করে চলেছে; কিন্তু তার যে বড় রকমের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে, তা নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ হাড়ে হাড়ে বোঝে। আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই তাদের গত মেয়াদের গডফাদারদের জন্য দলে কী ক্ষতি হয়েছে তা টের পেয়েছে। তারপরও যদি তৃণমূল পর্যায়ের বড় শক্তি নিয়ে সমৃদ্ধ এ বৃহত্তম দলটি বিরোধী দলের পরবর্তী আন্দোলন মোকাবেলার জন্য আবার সন্ত্রাসী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখে তবে তো আর তা ধামাচাপা দেওয়া যাবে না। গত জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে সতর্কতা অবলম্বনে, বিশেষত গডফাদার জাতীয় চিহ্নিত ক্ষতিকারক প্রার্থীদের মনোনয়ন না দিয়ে ভোটের সুফল এ দল ঘরে তুলেছে, দেশবাসী খুশি হয়েছে। কিন্তু আবার যদি এ দল জনমনের আস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তবে তো বলতে হয় দলটি নিজেদের ক্ষতি নিজেরাই ডেকে আনছে। কী দরকার ছিল কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে তিন সাংগঠনিক সম্পাদকের নারায়ণগঞ্জ গিয়ে শামীমকে দলের প্রার্থী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার? আওয়ামী লীগের মতো বড় দলও যখন একক প্রার্থী দেওয়ার আপসরফায় ব্যর্থ হয়েছে, তখন দল থেকে কাউকে সমর্থন না দেওয়ার যে কথা প্রথমদিকে বারবার উচ্চারিত হয়েছিল তা বহাল রাখাই তো উত্তম ছিল। আমরা তো পত্রপত্রিকায় এমনও দেখেছিলাম যে, আইভীর দিকে দলীয় সমর্থন আসতে পারে, তখন দেশের আমজনতা বলতে গেলে খুশিই হয়েছিল। কিন্তু পরে এমন কী ঘটল যে, দল আবার শামীমের দিকে ঝুঁকল? শোনা গেল, সামনের বিরোধীদলীয় আন্দোলন মোকাবেলায় শামীম বেশি উপযুক্ত হবে_ এমন কথা। কেন শামীম বেশি উপযুক্ত হবে? উত্তর কি তাহলে খালেদা জিয়ার রোডমার্চ আটকানোতে তার অতীত দক্ষতা? উত্তর কি তাহলে শামীমের দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠিত পূর্ব ভাবমূর্তি, যা দেশের জনগণের কাছে নেতিবাচক? উত্তর কি তাহলে এমন যে, আওয়ামী লীগ আবার পেশিশক্তিতে, সন্ত্রাসে, মাস্তানিতে অভিজ্ঞদের দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে বেশি কার্যকর ভাবছে? ভালো কথা, ধরে নিলাম এসবের কোনোটাই ঠিক নয়, শামীম বিএনপি আমলে বা তত্ত্বাবধায়ক আমলে দেশে না থাকলেও, পালিয়ে থাকলেও এলাকায় জনপ্রিয় এবং পৈতৃক ঐতিহ্যেও সুপ্রতিষ্ঠিত, অতএব তাকে বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু তখন তো বিপরীতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, আইভীরও এটা পৈতৃক ঐতিহ্য রয়েছে, আইভীও পৌরসভার মেয়র ছিলেন, আইভীও জনপ্রিয়। ঠিক আছে, দু'জনই আওয়ামী লীগের, দু'জনেরই জনপ্রিয়তা রয়েছে, বিপরীতমুখী হলেও দু'জনেরই ভাবমূর্তি রয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে দলের একমাত্র করণীয় হচ্ছে, কাউকে সমর্থন না দিয়ে জনগণের রায়ের ওপর ছেড়ে দেওয়া। এটা করা হলে দল প্রশংসিত হতো, দলীয় বিভেদ এত প্রখর হতো না, দলকে এত সমালোচনায় পড়তে হতো না। স্থানীয় নেতৃত্বের বিভাজন নিয়ে যে যতটুকু করতে পারে করুক, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হলো না। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তাতে বিএনপি লাভবান হয়ে যাবে, আওয়ামী ভোট ভাগ হয়ে গেলে তৈমুরের পোয়াবারো হয়ে যেতে পারে, জাতীয় নির্বাচনের জন্য এটার একটা প্রভাব থাকতে পারে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সূত্রে এটা আওয়ামী লীগের জন্য আরও ক্ষতি ডেকে আনতে পারে, ডিসিসির জন্য এ ফল আরও মারাত্মক হতে পারে। কিন্তু এখন কি আওয়ামী লীগ শামীমকে দলীয় সমর্থন দিয়ে লাভবান হলো? আমরা মনে করি, এ পর্যন্তও মেনে নেওয়া সম্ভব হয়েছে যে, তিন সাংগঠনিক সম্পাদকের শামীমকে সমর্থন দিলেও তা ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সমর্থন বলে আইভী চালিয়ে দিয়েছেন। কেননা, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হানিফ এবং সুরঞ্জিত বাবু ওই সমর্থনে দলীয় সমর্থন বলেননি। এখানে থেমে গেলেও আওয়ামী লীগের জন্য যথেষ্ট ছিল_ বলা চলে, সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না, যে যার মতো করে বুঝে নিল। কিন্তু পরে হানিফ সাহেবের শেষ কথায় শামীমের পক্ষে দলীয় সমর্থন প্রকাশ করে চরম ক্ষতিটা যে করে ফেললেন! এই যদি উদ্দেশ্য ছিল তাহলে মনোনয়ন প্রত্যাহারের আগেই তা করা সমীচীন ছিল।
এখন যদি সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতায়, নির্বাচন কমিশনের কঠোরতায় একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়ে যায়, এ নির্বাচনে যদি ভোটারদের সমর্থন আইভীর প্রতি সহানুভূতিতে বেড়ে যায়, আইভী যদি জয়লাভ করে ফেলেন তাহলে আওয়ামী লীগের মুখ রক্ষা হবে কি? আবার পাল্টাটাও যদি ভাবা হয় যে, শামীম জয়ী হলেন, কিন্তু জনগণ যদি এটাকে মেনে না নেয় অর্থাৎ আন্তরিকভাবে সন্তুষ্ট না হয় এবং ভিন্ন কোনো অভিযোগ তোলে তাহলেই-বা আওয়ামী লীগের লাভ কোথায়? তখন কি নারায়ণগঞ্জে দলীয় অপরাজনীতির ক্ষতিটা থেকে যাবে না? ধরা যাক, আইভী বা শামীম কেউ জয়ী হলেন না, এসে গেলেন তৈমুর, তখনই-বা আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নের সার্থকতা আর থাকবে কী? অথচ আওয়ামী লীগ দলের দু'জনের কাউকে সমর্থন না দিলে দলকে কোনো বদনামেই পড়তে হতো না। সামনের জাতীয় নির্বাচন মনে রাখলে নারায়ণগঞ্জের একটা মেয়রের পদ কি আওয়ামী লীগের জন্য সত্যি বেশি প্রয়োজন ছিল? জনগণ যাকে খুশি ভোট দিক_ এ উদারতায় কেন যেতে পারবে না এ দল?
ভোটারদের রায় নাসিক নির্বাচনে একটা নতুন মাইলফলক সৃষ্টি করতে পারে, রাজনীতিকদের চোখের পর্দা খুলে দিতে পারে, জাতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দলীয় ধান্ধাবাজির একটা মোক্ষম জবাবও হতে পারে। দল বড় না হয়ে ব্যক্তি-ইমেজও বড় হতে পারে, বিশেষত স্থানীয় নির্বাচনে_ এমন ফল যদি এসে যায় তাহলে আমরা সাধারণ গণতন্ত্রকামী মানুষ বোধহয় বেশিই খুশি হবো, জাতীয় রাজনীতির জন্যও সেটা হবে শিক্ষণীয়।

বদিউর রহমান : সাবেক চেয়ারম্যান
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
 

No comments

Powered by Blogger.