স্মরণ-স্মৃতির মুকুরে আবদুল মান্নান সৈয়দ by নাজনীন মহল অঞ্জনা

বদুল মান্নান সৈয়দ, যাঁর চলে যাওয়ার খবর আমার মেয়ে মৃদুলার কাছে শুনে প্রশ্ন করিনি, কোথায়-কখন-কিভাবে? ঝাপসা চোখে ভাসছিল মুখখানি। কানে বাজছিল সেই কথা, 'অঞ্জনা, ভালো আছেন তো? আমার জন্য দোয়া করবেন।' মান্নান ভাই ছিলেন আমাদের পরিবারের আপনজন, তাই তাঁকে হারানোর বেদনা এত স্পর্শকাতর।


আজ তাঁর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। শেষ কথা হয়েছিল চলে যাওয়ার মাত্র চার দিন আগে, ১ সেপ্টেম্বর। শারীরিক অবস্থা জানার জন্যই ফোন করেছিলাম। ধরলেন মান্নান ভাই_'হ্যালো অঞ্জনা, ভালো আছেন তো? আমার জন্য দোয়া করবেন।' দুর্বল শোনাচ্ছিল কণ্ঠস্বর; তাই বলেছিলাম, আপনার সঙ্গে কথা বলব না, আপনি বিশ্রাম নিন। ভাবিকে ফোনটা দিন। কথা হলো ভাবির সঙ্গে, লক্ষ্মী ভাবিটি বুঝে উঠতে পারছিলেন না কী করবেন চিকিৎসাবিমুখ জীবনসঙ্গীকে নিয়ে! মান্নান ভাইয়ের চিকিৎসাভীতি টের পেয়েছিলাম মাস তিনেক আগে। 'নজরুলের নারী জাগরণ' বিষয়ে কথা বলার জন্য ফোন করেছিলাম। বেশ ক্লান্ত-ভীত-উত্তেজিত ছিলেন বোঝা গেল। ফোন ধরেই বললেন, 'অঞ্জনা, এইমাত্র ল্যাবএইড থেকে ফিরলাম। আমার বন্ধু সায়ীদ (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ) আমাকে ধরেবেঁধে ডা. বরেণ চক্রবর্তীর কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ভীষণ ক্লান্ত। ডাক্তার এনজিওগ্রাম করতে বলেছে। এনজিওপ্লাস্টি করবে, রিং পরাবে। ওসব ঝামেলা করে লাভ নেই, ওষুধ খেয়েই ভালো থাকা যাবে। রানু (স্ত্রী), জিনান (মেয়ে) কিছুই বুঝতে চায় না, আপনি একটু বোঝান তো...' ইত্যাদি আরো কথা। বললাম, মান্নান ভাই, এনজিওগ্রাম করিয়ে ফেলুন। দরকার পড়লে রিং তখনই পরানো যাবে, আপনি তেমন কষ্টও পাবেন না। ভারী গলায় বলে উঠলেন, 'অঞ্জনা, আপনিও ওদের দলের হয়ে কথা বলবেন না। ওসব কাজ আমাকে দিয়ে হবেটবে না, বলে লাভও নেই। আল্লাহ্ যে কয় দিন হায়াত রেখেছেন, বাঁচব। ওপারের ডাক এলে যেতে হবেই।...' জাতীয় কবির তিরোধান দিবসে চ্যানেল আইয়ের সরাসরি সম্প্রচার অনুষ্ঠানে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ফোন দিয়েছিলাম মান্নান ভাইয়ের মোবাইলে। ড্রাইভার ফোন ধরে বলল, 'স্যারকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। এখন ভালো আছেন। বাসায় চলে যেতে চাইছেন।' পরদিন রাত সাড়ে ১১টায় মান্নান ভাইয়ের ফোন পেয়ে নানা চিন্তার ভিড় জমল মনে। এত রাতে তো কখনো ফোন করেন না মান্নান ভাই! ফোন তুলে আস্তে করে হ্যালো বলতেই ভাবির কণ্ঠ_"অঞ্জনা, কেমন আছেন আপনি? আপনার ভাই বারবার বলছে, 'অঞ্জনাকে ফোন দাও, আমার জন্য দোয়া করতে বলো'।" ভাবির মিষ্টি ব্যবহারে আপ্লুুত হয়েছিলাম। বাংলা সাহিত্যের সবটাতেই বেশিসংখ্যক পূর্বপুরুষকে নিয়ে লেখার প্রধানতম ব্যক্তি আবদুল মান্নান সৈয়দ, আমার বিশ্বাস উভয় বাংলায়। 'শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ' তাঁরই আবিষ্কার। নজরুল নিয়ে গবেষণার অন্ত ছিল না। পড়ে রইল তাঁর 'অভিনব নজরুল' উদ্ধার। ২০১০ সালে নজরুল একাডেমী আয়োজিত নজরুল সম্মেলনে প্রধান আলোচক ছিলেন মান্নান ভাই। ফোন করে বললেন, 'অঞ্জনা, আপনি তো নজরুলপ্রাণ মানুষ। বলুন তো, এবার আলোচনার বিষয় কী সাব্যস্ত করা যায়।' বললাম 'নারী জাগরণে নজরুল'। মান্নান ভাই হেসে বললেন, 'সময়োপযোগী বিষয়, চারদিকে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সুবাতাস।' রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, শিরাজী, রোকেয়া ও নজরুলের অসাধারণ ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘ ৩০-৩৫ মিনিট কথা বললেন টেলিফোনে। মান্নান ভাইয়ের কত কথা, কত স্মৃতি ভিড় করছে মনের খাতায়! খিলখিল ও আমি দুই পাশে বসায় বলেছিলেন, 'আমার একপাশে শিরাজী, এক পাশে নজরুলি।' আবদুল মান্নান সৈয়দের মতো সৎ ও স্বচ্ছ মানুষের অসময়ে চলে যাওয়া সাহিত্যাঙ্গনে বিরাট শূন্যতা। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।
নাজনীন মহল অঞ্জনা

No comments

Powered by Blogger.