বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-তৈরি পোশাক শিল্প খাত সম্পর্কিত আশা-জাগানিয়া প্রতিবেদন by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

বাংলাদেশের অর্থনীতি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। অর্থনীতি এবং তৎসংশ্লিষ্ট খাতগুলো বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করে চলেছে। দেশের অর্থনীতির বর্তমান চালচিত্র নানা মহলে খুব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সঙ্গে পর্যালোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প খাত অর্থনীতির বড় জোগানদার।


নানা রকম প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা (বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতা-অস্থিতিশীলতা) ডিঙিয়ে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা একটি সুনির্দিষ্ট জায়গা করে নিতে পেরেছেন। বিগত বিশ্বমন্দা পরিস্থিতির সময়ও আমাদের অর্থনীতিতে বিশেষ কোনো ধাক্কা লাগেনি। কিন্তু আমাদের সৃষ্ট নানা রকম সমস্যা-সংকট দেশ-জাতির অগ্রগতির পথে কখনো কখনো এমন অন্তরায় সৃষ্টি করছে, যা সামগ্রিক সম্ভাবনার দরজায় কুঠারাঘাত করে চলেছে। তৈরি পোশাক শিল্প খাতে ইতিমধ্যে এমন আঘাত লেগেছে বহুবার এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এর জন্য আমাদের এ খাতের ব্যবসায়ীদের যথেষ্ট খেসারতও দিতে হয়েছে। এর বিরূপ ধাক্কা লেগেছে জাতীয় অর্থনীতিতে।
কিন্তু আশার কথা হলো, এত কিছুর পরও এ খাত সম্পর্কিত সম্প্রতি কিছু সুবার্তা মিলেছে। দেশের তৈরি পোশাক শিল্প খাত থেকে রপ্তানি আয় আগামী পাঁচ বছরে দ্বিগুণ এবং ১০ বছরে তিন গুণে উন্নীত হওয়ার সুস্পষ্ট সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, যদি সব কিছু ঠিকঠাক থাকে, বিশেষ করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে, তাহলে এই খাতের রপ্তানি আয় আগামী ১০ বছরে ৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হতে পারে। 'ম্যাককিনসে অ্যান্ড কম্পানি' নামের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি খ্যাতনামা গ্লোবাল ম্যানেজমেন্ট কনসালটিং প্রতিষ্ঠানের পরিচালিত জরিপ প্রতিবেদনে এই সমুজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে চীনের পর বাংলাদেশকেই পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রভূত সম্ভাবনার দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পোশাকজাত পণ্যের উৎসের ক্ষেত্রে চীনের পর বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকেই পরবর্তী 'হটবেড' বা অপার সম্ভাবনার ঠিকানা হিসেবে সর্বতোভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাই ক্রেতাপক্ষ অর্থাৎ বায়ারদের সোর্সিং ক্যারাভ্যান বা আমদানি উৎসের সোপান এখন চীনমুখী না হয়ে বাংলাদেশমুখী হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকার বড় বড় বায়ার বাংলাদেশকেই এখন তৈরি পোশাক সোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচনা করছে। অবশ্যই এই বার্তা আমাদের নতুন করে আশান্বিত করেছে।
শুধু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাই আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতির পথে একমাত্র বাধা না হলেও প্রধান বাধা তো বটেই। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থিতিশীলতা সচেতন সব মহলের একান্ত কাম্য হলেও আমাদের জাতীয় রাজনীতির কর্ণধাররা একদিকে যেমন ক্ষীণ স্বার্থের ঊধর্ে্ব উঠতে পারছেন না, তেমনি অন্যদিকে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টিও যেমনভাবে আমলে নেওয়ার কথা, তেমনভাবে আমলে নিতে অদূরদর্শিতার দৃষ্টান্ত পুষ্ট করে চলেছেন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাবিহীন কোনো রাষ্ট্র কিংবা সমাজচিত্র উজ্জ্বল হতে পারে না_এ সত্যের মধ্যে কোনো ফাঁক নেই। দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে আমাদের অনেক অর্জনের যেমন বিসর্জন হয়েছে, তেমনি অনেক সম্ভাবনাও মুখ থুবড়ে পড়ছে। পাশাপাশি রয়েছে অবকাঠামো, বিদ্যুৎসহ আরো বেশ কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা-সংকট, যা আমাদের কাঙ্ক্ষিত মাত্রা স্পর্শের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করে রেখেছে। বিতর্ক নেই, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প এর পরও সক্ষমতা কিংবা পারদর্শিতা অনেকটাই অর্জন করেছে। এ খাতে বিগত কয়েক বছর চরম শ্রমিক অসন্তোষ পরিলক্ষিত হয়েছে। এ জন্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অদৃশ্য মহলকে বারবারই দায়ী করা হলেও তাদের শনাক্ত করা যায়নি। এও সত্য, তৈরি পোশাক শিল্প খাতের এমন কিছু উদ্যোক্তাও রয়েছেন, যাঁদের কর্মকাণ্ড 'আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়া'র শামিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বর্তমানে নতুন মজুরি কাঠামোর বাস্তবায়নসহ বিবিধ অসন্তোষ দূরীকরণের লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ায় আপাতত সুফল পরিলক্ষিত হলেও এর দীর্ঘস্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। কারণ অপরাজনীতির বিষবাষ্প ছড়িয়ে ব্যক্তি কিংবা দলীয় স্বার্থ হাসিলের অপক্রিয়া থেমে নেই।
বায়াররা বাংলাদেশ থেকে আরো অনেক বেশি ফ্যাশনেব্ল অর্থাৎ বৈচিত্র্যপূর্ণ ও জমকালো ধরনের পোশাকপণ্য কিনতে চায়_এ তথ্য রয়েছে ওই প্রতিবেদনে। তবে এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি পারদর্শিতা ও সক্ষমতা অর্জন করতে হলে এই খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের পারফরম্যান্স আরো শাণিত করতে হবে। একই সঙ্গে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর উৎপাদনশীলতারও উন্নয়ন অপরিহার্য। বাংলাদেশ যদি তার পোশাক শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির সুযোগ-সম্ভাবনাকে ২০২০ সাল নাগাদ তিন গুণ করতে চায়, তাহলে আমাদের গড় উৎপাদনশীলতা ভারতের সমপর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। ভারতের পোশাক কারখানার ৯২ শতাংশ উৎপাদনশীলতার (প্রোডাক্টিভিটি) বিপরীতে বাংলাদেশের মাত্র ৭৭ শতাংশ। সম্প্রতি খ্যাতনামা আরেকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষায় প্রকাশ, বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় তৈরি পোশাক শিল্প খাত তার দুর্দমনীয় যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। এসব বার্তা নিশ্চয়ই সরকারের নীতিনির্ধারক এবং জাতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রকদের কানে পেঁৗছেছে। কিন্তু তাঁরা বিষয়গুলো কতটা আমলে নেবেন এবং জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তরিক হবেন, এ নিয়েও সংগতই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
তবে আশার কথা আরো আছে। বর্তমানে চীন বিভিন্ন কারণে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য একটা সুযোগ বৈকি। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার তৈরি পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছে। এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে, যদি যথাযথ প্রণোদনা এবং ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়। তৈরি পোশাক শিল্প খাতে এখন কর্মযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে এই বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের কর্মসংস্থানের বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের গুণগত মানের পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্যের দামও তুলনামূলকভাবে কম। কারণ এখানে শ্রমমূল্য যথেষ্ট কম। কিন্তু যাদের শ্রমে-ঘামে এই শিল্পটি এ পর্যন্ত এগিয়েছে, তাদের বেশির ভাগের বঞ্চনা-দুর্ভোগ লাঘবের বিষয়টি এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। তাদের কেউ কেউ এখনো প্রতারণার জালে আটকে রাখতে চাইছেন_এই অভিযোগও অমূলক নয়। পরোক্ষভাবে এই খাতের সঙ্গে জড়িত আছে আরো অসংখ্য মানুষ। এই খাত থেকে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব পাচ্ছে। এ অবস্থায় এ ক্ষেত্রে সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, দক্ষতা-দূরদর্শিতার সঙ্গে সেগুলোর মোকাবিলা করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সাফল্যের পূর্ণ মাত্রা স্পর্শ করার স্বপ্ন বাস্তবায়নের বিষয়টি।
কমপ্লায়েন্স শর্তাবলি পূরণ করা, কাঁচামালের সরবরাহ সুনিশ্চিত করা, ব্যাংকঋণের সুদের হার হ্রাস করা, বিদ্যুৎ-জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্র উন্নয়ন, মানবসম্পদের প্রতি গুরুত্ব আরোপ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং বন্দরসহ যাবতীয় সহায়ক ক্ষেত্রে বিদ্যমান জটিলতার নিরসন আশু জরুরি। দেশের পোশাক শিল্পের সম্ভাবনা ও সুযোগ সম্পর্কে যে বার্তা মিলল, তা জাতীয় অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক, এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। বর্তমানে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ আয় আসে এই খাত থেকে। বাংলাদেশের প্রতি বায়ারদের যে আস্থা জন্মেছে, তা রক্ষার দায় সংশ্লিষ্ট সবার। বায়ারদের যে আগ্রহ-চাহিদা রয়েছে, সে ক্ষেত্রে সক্ষমতা অবশ্যই আরো বাড়াতে হবে। তৈরি পোশাক শ্রমিকসহ উৎপাদনসংশ্লিষ্ট সবার যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাটাও খুবই জরুরি। প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধাও নিশ্চিত করা চাই। জ্বালানি সরবরাহ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। জ্বালানি খাত এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয়ভাবে কাঁচামালের সক্ষমতা বাড়ানো খুব দরকার। লিডটাইম রক্ষা করতে হবে এবং এ জন্য যা যা প্রয়োজন, সেগুলো নিশ্চিত করার দায় সর্বাগ্রে সংশ্লিষ্টদের। এই প্রেক্ষাপটে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ দ্রুতায়িত করতে হবে। সমুদ্র ও বিমানবন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে দক্ষতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে দৃষ্টি দিতে হবে রেলওয়ের কনটেইনার ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির দিকেও। এসব বিষয় নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। সম্ভাবনা ও সুযোগ কারো জন্য অপেক্ষায় থাকবে না। সময়ের কাজ যদি সময়ে করা না যায়, তাহলে পস্তাতে হবে। এমন পস্তানোর ঘটনা অতীতে অনেকবার ঘটেছে। ভবিষ্যতে যাতে আর না ঘটে, তা নিশ্চিত করার দায় যাদের, তারা দ্রুত সজাগ থাকলেই মঙ্গল।

লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.