আমি এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট

ছোটবেলায় আমার প্রিয় তিন ক্রিকেটার ছিলেন—রাহুল দ্রাবিড়, ব্রায়ান লারা আর বাংলাদেশের আতহার আলী খান। তাঁদের এমন কোনো স্টিকার, ভিউকার্ড, পোস্টার ছিল না, যা আমার সংগ্রহে ছিল না। কিন্তু আতহার আলীর কোনো পোস্টার দোকানে পাওয়া যেত না। বড়রা আমার সমবয়সী কাউকে যদি জিজ্ঞেস করতেন, তুমি বড় হয়ে কী হবে? সবাই বলত ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার। আমি বলতাম, ক্রিকেটার হব। গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহে এবং শীতের ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন বিকেলেও


দিনের পর দিন ব্যাট-বল নিয়ে মাঠে পড়ে থাকতাম। স্বপ্ন একটাই—ক্রিকেটার হব। থাকতাম দেশের প্রায় শেষ প্রান্তের জেলা পঞ্চগড়ের এক উপজেলার ছোট্ট একটা গ্রামে। তাই আমার মতো স্বপ্নসাধকের খোঁজ পায়নি কেউ। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নটাও আর পূরণ হয়নি আমার। কিন্তু এই ক্রিকেট মোহে অনেক পাগলামি করেছিলাম ছোটবেলায়। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে মিনি বিশ্বকাপ হবে। জয়াসুরিয়া, শেন ওয়ার্ন, লারা, টেন্ডুলকারের মতো তারকা খেলোয়াড়েরা আসবেন বাংলাদেশে—এই ভেবে আমার ঘুম হয় না। আমি অস্থির হয়ে গেলাম ঢাকায় গিয়ে সরাসরি গ্যালারিতে বসে খেলা দেখার জন্য। কিন্তু কীভাবে? বাসায় বলে কোনো কাজ হবে না। মায়ের কাছে টাকা চাইলাম অন্য অজুহাতে। কিন্তু তখন আমি ছোট। ক্লাস নাইনে পড়ি। ওইটুকু ছেলেকে কি আর কোনো মা অত টাকা দেয়। উপায় না দেখে আমার সদ্য কেনা নতুন কেডস আর ক্লাসের পাঠ্যবই লাইব্রেরি মূল্যের ৩০% ডিসকাউন্টে বিক্রি করে দিলাম ক্লাস এইটে পড়া এক ছোট ভাইয়ের কাছে। তত দিনে খেলা প্রায় শেষের দিকে। যা-ই হোক, বাসায় কাউকে কিছু না বলে খেলা দেখার জন্য ৫০০ মাইল রাস্তা পাড়ি দিয়ে চলে গেলাম রাজধানী ঢাকায়।
গেলাম তো, কিন্তু রাতে থাকব কোথায়, স্টেডিয়ামটাই বা কোন দিকে? এত মানুষ! এত গাড়ি, রিকশা...! অনেক হয়রানির পর এক হোটেলে বয়ের চাকরি নিলাম। আমার কাজ শুধু টেবিলে টেবিলে পানি দেওয়া। রাতে ঘুমানোর আগে সমবয়সী একজনকে সব খুলে বললাম। সে কিছুটা বুঝল, তারপর খোঁজখবর নিয়ে জানাল, এসব খেলার টিকিট এভাবে পাওয়া যায় না। কয়েক দিন আগে টিকিট কিনতে হয়। তা ছাড়া নতুন চাকরি, হোটেল ম্যানেজার ছুটি দেবে না। আমি ছুটি না নিয়েই চলে গেলাম স্টেডিয়ামে। কিন্তু কোনোভাবেই স্টেডিয়ামে ঢুকতে পারলাম না। ফাইনাল খেলা শেষে একদিন ফাঁকা মাঠের আশপাশে গিয়ে ঘুরঘুর করতে লাগলাম। তারপর গেটের দারোয়ানকে বলে জীবনে প্রথম ঢুকলাম বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়ে খালি পায়ে দাঁড়ালাম। আমার স্বপ্নের মাঠ, স্বপ্নের গ্যালারি, স্বপ্নে দেখা টেন্ডুলকার, মাইকেল বেভান, জন্টি রোডস, ওয়াসিম আকরামের মতো খেলোয়াড়েরা এই মাঠে খেলেছেন কয়েক দিন আগে, আমি সেই মাঠে দাঁড়িয়ে আছি! ব্রায়ান লারা, সৌরভ গাঙ্গুলীর ঘাম শুকিয়েছে যে ঘাসে, সেই ঘাস আমি ইচ্ছা করলেই হাত দিয়ে ছুঁতে পারি। কী অদ্ভুত! কী স্বপ্নময়! কী অবিশ্বাস্য!
মিনি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ছিল না। পরের বছর বাংলাদেশ যখন প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে ইংল্যান্ডে গেল, কী যে অবাক হয়েছিলাম। টিভির সামনে বসে সবকিছু অপার্থিব মনে হচ্ছিল। আমরা ওয়ার্ল্ড কাপ খেলছি! টেলিভিশনে আমাদের খেলা দেখাচ্ছে। ওই যে আমাদের রাজশাহীর ছেলে পাইলট দাঁড়িয়ে আছেন গিলক্রিস্টের পেছনে। ওই যে ওয়াসিম আকরামের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন আমাদের আকরাম খান। কী আজব! কী গর্ব! কী সুন্দর!
এখন অবশ্য সেই সব দিনের অনুভূতি পার হয়েছে অনেক আগেই। সাকিব-তামিমরা আসার পর থেকে দল এখন অনেক আত্মবিশ্বাসী। এখন আমরা শুধু শেখার জন্যই খেলি না, জেতার জন্যও খেলি। এক সিরিজে এক ম্যাচ জিতলেই বিজয় মিছিল বের করি না, পুরো সিরিজ জিততে চাই। আবার বিশ্বকাপে তিন ম্যাচ জিতেও খুশি হই না। সেমিফাইনালে যেতে চাই। ২০১১ সালটা যদিও খুব খারাপ গেল, কিন্তু এ বছরই আমরা দলে আরও দুজন নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান পেয়েছি—নাসির ও নাজিমউদ্দিন। বিশ্বের অন্যতম সেরা বোলিং দল পাকিস্তানের বিপক্ষে নাসির, সাকিব, শাহরিয়ার, নাজিমউদ্দিনের ভালো পারফরম্যান্স প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ দলের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা।
স্বপ্ন দেখি, নতুন বছরে নতুন আলোয় দেখা দেবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। তাহলে আমরা ২০১২ থেকেই শুরু করি, নাকি?
 রবিউল করিম, মোহাম্মদপুর, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.