অসময়ের স্বপ্ন-আমার দুঃস্বপ্নের রাত ও আট বাঙালির শিরশ্ছেদ! by আরিফুজ্জামান তুহিন

মি প্রায় সময় একটি স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন না বলে একে দুঃস্বপ্ন বলাই বেশি যৌক্তিক। দুঃস্বপ্নে দেখি, আমার দিকে তেড়ে আসছে বিরাট এক আরব। তার চোখ ছুরির ফলার মতো। জিহ্বা লক লক করছে। হাতে রুপালি জোছনার মতো তলোয়ার। তার নিশানা আমার ঘাড়ের দিকে। আমি প্রাণ বাঁচানোর জন্য দৌড়াই। তবে সেই বিশালদেহী আরব আমার পিছু ছাড়ে না। আমি ঘুমের মধ্যেই বুঝতে পারি, এ নিছক স্বপ্ন। ঘুম ভেঙে গেলেই আমি দেখব আমার পরিচিতদের। কিন্তু আমার ঘুম


ভাঙে না। আমাকে সেই বিশালদেহী আরব মরুভূমির বালুর মধ্যে ফেলে দেয়। আমার গলার ওপর রুপালি জোছনার তলোয়ার নেমে আসে। স্বপ্নের মধ্যে জ্ঞান হারানোর চেষ্টা করি, আর ঠিক তখনই আমার ঘুম ভেঙে যায়, আমি আবার বেঁচে উঠি। তখন আমার বুকের মধ্যে হাপরের মতো ওঠানামা করে। এ স্বপ্ন আমি কেন দেখি তার কোনো ব্যাখ্যা আমাকে কেউ দিতে পারেনি। আমি কখনো সৌদি আরব বা মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিনি। আমার সঙ্গে কোনো আরবের কথা হয়নি কখনো। কখনো আমি হতভাগা আট শ্রমিকেরও একজন ছিলাম না। তাহলে এ স্বপ্ন আমি কেন দেখি!
আমার জানার সুযোগ নেই শিরশ্ছেদ হওয়া আট বাঙালি কী স্বপ্ন দেখতেন? নাকি সেই স্বপ্নের মধ্যে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ। কত শত নাম জানা নদী। ঘাসফড়িং। মায়ের ম্লান মুখ। মুঠোফোনে প্রিয়তমার ফেরার আকুলতা। প্রিয় স্কুল, স্মৃতির বটগাছ। প্রার্থনার মসজিদ। এসবের কথা কি তাঁদের খুব মনে পড়ত? নাকি আমার মতো, বিশাল এক আরবদেহী ছুটে আসত রুপালি জোছনার মতো তলোয়ার নিয়ে শিরশ্ছেদ করতে? আমাদের আর কখনোই এসব জানা হবে না।

*২.
সৌদি আরবে আট বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ নিয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, জাতিসংঘ পর্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, শিরশ্ছেদের ঘটনায় তাঁরা মর্মাহত; কিন্তু ইসলামী আইনের প্রতি তাঁরা সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল। সৌদি আরবে আটজনকে প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ করে তা আবার ইসলামের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো। তাহলে বিষয়টি হলো, ইসলামে শিরশ্ছেদ বিষয়টি অনুমোদন দেয়, আর সৌদি আরবে ইসলামী শাসনতন্ত্র কায়েম আছে। এর মধ্য দিয়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ কথিত 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের' নামে যে ইসলামবিরোধী বর্বরোচিত বর্ণবাদী যুদ্ধের ঘোষণা করেছিল, সৌদি রাষ্ট্রদূত যেন তাকেই সমর্থন করে গেলেন। সৌদি আরব আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসকশ্রেণীর সম্পর্ক এবং স্বার্থ দীর্ঘদিনের। তাঁরা একে অপরের পিঠ চাপড়াচ্ছে। এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইরান আক্রমণসহ সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র মিলিতভাবে বিভিন্ন ধরনের যড়যন্ত্র করে আসছে। সেসব প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে যদি আজকের সৌদি আরবের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যায় তাহলে কিছু প্রশ্ন সামনে চলে আসবে? তা হলো_ইসলামী আইনের নামে পবিত্র জুমার দিনে প্রকাশ্যে আটজন মানুষের শিরশ্ছেদ করা হলো, সেই ইসলামী আইন কি আদৌ সৌদি আরবে আছে? পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ঈদের দিনে ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসি দিয়েছিল বর্বর মার্কিনরা।
এ ধরনের বাস্তবতায় আমাদের পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েস গণমাধ্যমের কাছে বললেন, 'সৌদি আরবে যা হয়েছে তা নিয়ম মেনেই হয়েছে।' এ ধরনের জ্ঞানী কথা আমরা তাঁর কাছ থেকে কেন পেলাম! এই নিয়মটা কি ইসলামের, নাকি সৌদি রাজতন্ত্রের? বিষয়টি যদি মিজারুল কায়েস আমাদের খুলে বলতেন, তাহলে দেশের মানুষ একটি সান্ত্বনা পেত।
সেই সান্ত্বনা পাওয়ার আগে আজকের সৌদি আরবের হাল-হকিকত আমাদের একটু খুঁজে দেখা দরকার। বরাবরই শাসকশ্রেণীর একটি আইন থাকে, যার তলোয়ারের নিচে মানুষ কাটা পড়ে। এ কারণে রাষ্ট্রকে শ্রেণী-নিপীড়নের হাতিয়ার বলা হয়। তবে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইসলামে রাষ্ট্রের কোনো ধারণা নেই। তার মানে হজরত মুহাম্মদ (সা.) রাষ্ট্র তৈরি করে সেখানে শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র বানাতে চাননি। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মদিনার সনদ নিয়ে অনেক কথাই বলা যেতে পারে, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু ধর্মের নামে শাসকশ্রেণীর এ হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু সব যুগেই শাসকশ্রেণীর ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য ধর্মকেই ব্যবহার করা হয়েছে। ধর্মের আবির্ভাব এবং ধর্মের উদ্দেশ্যের জন্য এটা সত্যিই ট্র্যাজেডি, আইরনি তো বটেই।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা ও মদিনায় ইসলাম বিজয়ের পর ওই অঞ্চলের নামকরণ করেন 'আল-হিজাজ'। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে আল-হিজাজের শাসনভারের পরিবর্তন হয়। তবে ১৯৩২ সালে সালাফি মতাবলম্বী আবদুল আজিজ বিন সৌদ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশটির নেতৃত্ব নেন। আল-হিজাজ নামের পুরো দেশটি দখলের আগে এই সালাফি মতাবলম্বীরা ১৯০২ সালে রিয়াদ দখল করে সেখানে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
এ কথা সব মুসলিম মতাবলম্বী মনে করেন যে ইসলামে রাজতন্ত্রের ধারণা নেই। ইসলামে যদি রাজতন্ত্রের ধারণা না থাকে, তাহলে ইসলামী আইনে রাজতন্ত্র বিপরীত ধরনের মতাদর্শ ও সাংঘর্ষিক হবে_এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে মানুষগুলোকে শিরশ্ছেদ করা হলো, তাঁদের কিন্তু ইসলামের নামেই করা হলো। যে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে কারবালার প্রান্তরে শহীদ হলেন শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসেন, সেই রাজতন্ত্রীরাই এখন মুহাম্মদের ইসলামের নামে সৌদি আরবে মানুষের শিরশ্ছেদ করছেন। আর তা চাপিয়ে দিচ্ছেন ইসলামের ওপর।
ইমেইল : স.ধৎরভুঁুধসধহ০১@মসধরষ.পড়স

No comments

Powered by Blogger.