বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৭৭ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। হারেছ উদ্দীন সরকার, বীর প্রতীক সফল অভিযানের বীর যোদ্ধা রাতের অন্ধকারে সীমান্ত এলাকা থেকে জিপ গাড়িতে বাংলাদেশের ভেতরে রওনা হলেন হারেছ উদ্দীন সরকার, ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (বীর বিক্রম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল), নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, আফজাল হোসেন, শওকত আলীসহ ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা। গাড়ির হেডলাইট নেভানো। পথে আছে পাকিস্তান


সেনাবাহিনীর সতর্ক প্রহরা। তা ফাঁকি দিয়ে পৌঁছালেন লক্ষ্যস্থল বড়খাতা তিস্তা রেলসেতুর অদূরে। সেখান থেকে রেলসেতুর দূরত্ব দুই মাইল। তাঁদের সঙ্গে আছে বিস্ফোরক, ডেটোনেটর এবং একটি হালকা মেশিনগান ও তিনটি সাবমেশিন কারবাইন বা স্টেনগান; আর মাত্র একটি তিন ইঞ্চি মর্টার। তাঁরা তিস্তা রেলসেতু ধ্বংস করবেন। এর আগে তিন তিনবার এ অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। এবার তাঁদের সফল হতেই হবে। সেদিন পরিস্থিতি তাঁদের কিছুটা সহায় হলো। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। এ সুযোগে তাঁরা সেতুতে বিস্ফোরক স্থাপন করলেন। নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করে ডেটোনেটরে আগুন দিয়ে দূরে অবস্থান নিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রচণ্ড শব্দে গোটা এলাকা কেঁপে উঠল। বৃষ্টিপাতের মধ্যে মনে হলো, আকাশ ভেঙে একের পর এক বজ্রপাত হচ্ছে বড়খাতার তিস্তা সেতুর ওপর। একই সময় পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান লক্ষ্য করে গর্জে উঠল তাঁদের সবার অস্ত্র। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ১২ আগস্টের।
বড়খাতা লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার অন্তর্গত। পাটগ্রাম থেকে রেল ও সড়কপথ বড়খাতা হয়ে জেলা সদরে এসেছে। বড়খাতায় আছে রেলসেতু। ১৯৭১ সালে সীমান্ত এলাকায় চলাচলের জন্য ওই রেলসেতু বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ সেতু রক্ষার জন্য সেখানে নিয়োজিত ছিল এক কোম্পানি পাকিস্তানি সেনা। পাকিস্তানি সেনাদের চলাচল ব্যাহত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকবার তিস্তা রেলসেতু ধ্বংসের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। কিন্তু প্রতিবারই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধে তাঁরা ফিরে আসতে বাধ্য হন।
একের পর এক অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর ৬ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক পাটগ্রাম সাবসেক্টরের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ও কোম্পানি কমান্ডার হারেছ উদ্দীন সরকারকে ডেকে অবিলম্বে সেখানে সফল অভিযান পরিচালনার জন্য বলেন। তাঁর নির্দেশে তাঁরা আগের অভিযানগুলোর ব্যর্থতা ও ভুলত্রুটি বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এ অভিযানে অসীম সাহসী হারেছ উদ্দীন সরকার যথেষ্ট সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বড়খাতার তিস্তা রেলসেতু ধ্বংস উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ সেতু ধ্বংসের অপারেশন বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত ব্রিজ অন রিভার কাউয়াই ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। এ অপারেশন তার চেয়ে কম ছিল না। যুদ্ধের ইতিহাসে ব্রিজ অন রিভার কাউয়াই-এর নাম যদি থাকে, তবে ব্রিজ অন রিভার তিস্তার নামও বীরত্বগাথা হিসেবে চিরকাল ইতিহাসে থাকবে।
হারেছ উদ্দীন সরকার ১৯৭১ সালে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে ভারতে যান। প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ৬ নম্বর সেক্টরের পাটগ্রাম সাবসেক্টরে। বেশ কয়েকটি যুদ্ধে তিনি অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য হারেছ উদ্দীন সরকারকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৩৬১।
হারেছ উদ্দীন সরকার ২০০৪ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার (ডাক গিরাই) বদলী বাথান গ্রামে। তবে বসবাস করতেন রংপুর শহরের গণেশপুরে। স্বাধীনতার পর তিনি রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম সেরাজ উদ্দীন সরকার। মা ওলিমননেছা। স্ত্রী হাবিবা ফেরদৌসী। তাঁদের তিন মেয়ে, দুই ছেলে।
সূত্র: ফেরদৌসী হ্যাপি (হারেছ উদ্দীন সরকারের মেয়ে) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৬।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.