আজ চার দলের রোডমার্চ-ব্যয় হচ্ছে ১০ কোটি টাকা by টিপু সুলতান, তানভীর সোহেল ও আবু তাহের

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে বিএনপির রোডমার্চে কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। গাড়িভাড়া, সমাবেশে আগতদের আসা-যাওয়া, খাওয়ার খরচ, হোটেলভাড়া, মঞ্চ, তোরণ ও ব্যানারের পেছনে এই খরচ হচ্ছে বলে বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। দলীয় ও ভাড়া গাড়ির মালিক-কর্মকর্তাদের সূত্র জানায়, এই রোডমার্চে শুধু গাড়িভাড়া বাবদ প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা, তেল ও টোল বাবদ ব্যয় হবে আরও প্রায় এক কোটি টাকা, ফেনীতে


জনসভার জন্য আড়াই কোটি টাকা, চট্টগ্রামে জনসভার জন্য দেড় কোটি টাকা, কুমিল্লার তিনটি পথসভার জন্য ৪০ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামে হোটেলভাড়া বাবদও খরচ হচ্ছে বড় অঙ্কের টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রের স্বীকার করা এই হিসাবের বাইরেও বড় অঙ্কের টাকা জোগাড় ও খরচ হয় বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
আজ সকাল ১০টায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে এই রোডমার্চ শুরু হবে। এতে নেতৃত্ব দেবেন খালেদা জিয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে এই রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর আগে সিলেট, উত্তরাঞ্চল ও খুলনা অভিমুখে একই দাবিতে রোডমার্চ করা হয়।
গাড়ির ব্যয়: বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, ঢাকা থেকে প্রায় চার হাজার গাড়ির বহর চট্টগ্রাম অভিমুখে চারদলীয় জোটের রোডমার্চে অংশ নেবে। আর দুই হাজার গাড়ি বিভিন্ন স্থান থেকে রোডমার্চে যুক্ত হবে। শুধু ঢাকা থেকে তিন হাজার গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে।
গাড়ি ভাড়া দেয় এমন একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, তিন হাজার গাড়ির ভাড়া বাবদ বিএনপিকে খরচ করতে হচ্ছে নূন্যতম সাড়ে চার কোটি টাকা। অন্য গাড়িগুলোর তেল ও টোল বাবদ ব্যয় হবে আরও প্রায় এক কোটি টাকা।
রাজধানীর পুরান ঢাকা, খিলগাঁও, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরকেন্দ্রিক ভাড়া গাড়ির (রেন্ট-এ কার) ব্যবসায়ী ও সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেও ভাড়ার টাকার অঙ্কের বিষয়ে কাছাকাছি তথ্য পাওয়া গেছে।
বিএনপির সূত্র জানায়, রোডমার্চের গাড়িবহরে যুক্ত হতে ঢাকার ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে কমপক্ষে দুই হাজার ৮০০ মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কার গতকাল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাড়া করা হয়েছে। এর বাইরে টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার থেকেও গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে।
রোডমার্চ ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রধান ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা দেশ থেকে নেতা-কর্মীদের মধ্যে রোডমার্চ ঘিরে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা রয়েছে। কেবল ঢাকা থেকে বহরে থাকবে চার হাজার গাড়ি। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জসহ অন্যান্য জেলা থেকে আরও দুই হাজারের মতো গাড়ি রোডমার্চে অংশ নেবে। আশা করছি, ছয় হাজার গাড়ির এই রোডমার্চ হবে সর্বকালের সবচেয়ে বড় রোডমার্চ।’
রেন্ট-এ কারের ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত অন্য সময়ের তুলনায় রোডমার্চে অংশ নেওয়া গাড়ির ভাড়া কম নিতে হয়। কারণ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা গাড়ি ভাড়া করেন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে দুই দিনের জন্য গাড়ি ভাড়া নিলে ১৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। কিন্তু এখন কিছুটা কম নিতে হচ্ছে।
বিএনপির রোডমার্চ আয়োজক কমিটির এক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, খরচের বিষয়টি কেন্দ্রীয়ভাবে বলা যায় না। বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা পৃথকভাবে এই কাজ করে থাকেন। কেন্দ্রীয় কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে হয়তো ৩০ লাখ টাকার মতো খরচ হতে পারে। তবে ওই নেতা বলেন, এককটি রোডমার্চের পেছনে কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়। এর হিসাব নির্ণয় করা কঠিন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই নেতা বলেন, জনসভা ও পথসভায় বিভিন্ন স্থান থেকে নেতা-কর্মীরা যোগ দেন। তাঁদের খাবার ও যাতায়াত খরচ আছে। এগুলো স্থানীয় নেতারা বহন করেন। তা ছাড়া জনসভায় আসা ব্যক্তিদের ‘হাতখরচ’ দেওয়ার একটা অলিখিত রেওয়াজও চালু হয়েছে। প্রতিটি গাড়িতে থাকা নেতা-কর্মীদের খাওয়ার খরচও সংশ্লিষ্ট নেতাদের বহন করতে হয়।
ফেনীতে খরচ আড়াই কোটি টাক: রোডমার্চ কর্মসূচিতে শুধু ফেনীতেই ব্যয় হচ্ছে আড়াই কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে অর্ধকোটি টাকার সংস্থান করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে। বাকি টাকা সংগ্রহ করা হচ্ছে স্থানীয়ভাবে।
রোডমার্চ কর্মসূচির বড় দুটি জনসভার একটি হবে আজ ফেনীতে। খালেদা জিয়ার জেলা হওয়ায় এখানে বড় ধরনের জনসমাগমের উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। এই আয়োজনে জড়িত একাধিক দায়িত্বশীল নেতা প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও প্রকৃত খরচ হবে কয়েক গুণ বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই নেতা বলেন, এর বাইরে জেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা এবং কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ ফেনীর আরেক ব্যক্তিত্ব এই আয়োজনের জন্য অন্তত দুই কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করেছেন। ঢাকা থেকেই তাঁরা এই তহবিল সংগ্রহ করেন বলে দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।
ফেনী পাইলট স্কুল মাঠে জনসভা মঞ্চ তৈরি, এক সপ্তাহ ধরে সারা জেলার প্রতিটি হাটবাজার, গ্রামগঞ্জ ও শহরে মাইকে প্রচার, মহাসড়কসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে শত শত তোরণ নির্মাণ, রোডমার্চে গাড়িবহরের সঙ্গে আসা নেতাদের ফেনীতে মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় হবে।
দলীয় সূত্র জানায়, জেলার ছয়টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে দলীয় কর্মী-সমর্থক জনসভাস্থলে আনার জন্য প্রায় ৫০০ বাস, মাইক্রোবাস ভাড়া করা হয়েছে। এসব গাড়িভাড়া বাবদ অন্তত ১০ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে।
দাগনভূঁঞা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আকবর হোসেন বলেন, তাঁর এলাকা থেকে ১১৬টি গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। সব টাকার ব্যবস্থা তিনি করবেন। আকবর বিএনপির চেয়ারপরসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছোট ভাই।
পরশুরাম উপজেলা থেকে ১১০টি, সোনাগাজী থেকে ১০০, ফুলগাজী থেকে ৪০টি গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। এ বাবদ খরচ স্থানীয়ভাবে চাঁদা তুলে ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জানতে চাইলে ফেনী সদর বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মিজানুর রহমান দাবি করেন, খরচের বাজেট তিনি জানেন না।
চট্টগ্রামে খরচ জনসভায়: চট্টগ্রামে সমাবেশের আগের দিন রাতে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের রাত যাপনের জন্য নগরের অন্তত ১৫টি কমিউনিটি সেন্টার এবং বিভিন্ন আবাসিক হোটেলের চার শতাধিক কক্ষ ভাড়া নিয়েছে বিএনপি।
নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রামের জনসভার জন্য অন্তত দেড় কোটি টাকা খরচ হতে পারে। তবে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা খরচের অঙ্ক অনেক কম বলে দাবি করছেন।
নগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বাইরের জেলার নেতাদের অনুরোধে আমরা কয়েকটি কমিউনিটি সেন্টার ও আবাসিক হোটেলের চার শতাধিক কক্ষ বুকিং দিয়ে রেখেছি। ব্যবহারকারীরা ভাড়া পরিশোধ করবে। এর ভার আমাদের নয়।’
রোডমার্চের বাজেট প্রসঙ্গে আমীর খসরু বলেন, ‘মঞ্চ তৈরি, ব্যানার, মাইক ও অন্যান্য বাবদ আমাদের ২০ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। দলীয় নেতারা চাঁদা তুলে টাকার জোগান দিয়েছেন।’
মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাতক আসলাম চৌধুরী বলেন, ‘নেতা-কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ডিজিটাল ব্যানারের ব্যবস্থা করেছে। নগরে এ রকম কয়েক হাজার ব্যানার সাঁটানো হয়েছে, যেখানে বিএনপির তহবিল থেকে কোনো খরচ হয়নি। তবে মাইক ব্যবহারের জন্য আমরা সামান্য টাকা খরচ করেছি।’
বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন, বড় আকৃতির একটি ডিজিটাল প্রিন্টের ব্যানারের জন্য ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ছোট ব্যানারে খরচ কম। ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা এই খরচের জোগান দিচ্ছেন।
গোলাম আকবর আরও বলেন, প্রতিটি উপজেলা ও জেলা থেকে গড়ে শতাধিক বাস ভাড়া করে নেতা-কর্মীরা জনসভায় যোগ দেবেন। বাসভাড়া ও আনুষঙ্গিক খরচের টাকা সংশ্লিষ্ট উপজেলা বা জেলা কমিটি থেকে জোগান দেওয়া হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.