ইতিহাসের মুখ: পারলি না! by সানাউল হক খান

সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু, অনলে পুড়িয়া গেল...’ দূরকৈশোরে যাত্রাপালায় একটি গানের প্রথম লাইনটি এখন বারবার মনে পড়ছে। মনে পড়ছে এ কারণে যে, দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা বাফুফের কমিটি বর্তমানে যাঁদের নিয়ে আছে, তাঁদের অনেকেই জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড়। কেউ কেউ তো দুর্দান্ত মানের। জাতীয় এবং বহু স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক একাধিকবার পুরস্কৃত। অথচ হালে তাঁরা পানি পাচ্ছেন না: ফুটবলের ইতিহাসের জঘন্যতম ফলাফলের লজ্জা
নিবারণের পোশাকটি পর্যন্ত তাঁদের গতরে নেই। তাঁদের কোনো দুঃখবোধ নেই, আফসোস নেই, হাহাকার নেই, মাথাব্যথা নেই! আর ওই যে একটি শব্দ আছে না ‘জবাবদিহি’, ওটার ধার ধারে না এই কমিটি। বুট-জার্সি-ময়দান বলতে যে ফুটবলের আরক রয়েছে, সেই দ্রবীভূত দাওয়াইটি দিয়ে কোনো সুদূরপ্রসারী রোগ নিরাময়ের কর্মশালা নেই। হোমিওপ্যাথি মতে, আরক দিয়ে বিভিন্ন পাওয়ারপটেন্সি তৈরির যে সুযোগ থাকে, বাফুফেতে সেই সুযোগ্য হোমিওপ্যাথ নেই, আছে শুধু ওষুধ নির্মাণের ভেজাল বিদেশি কারখানা।
আর এই কষ্টের বিপরীত পৃষ্ঠায় কী লেখা? পণ্য ভেজাল নয়, কাঁচামাল ভেজালেরও কোনো প্রকৃষ্ট প্রমাণ নেই, শুধুই অপপ্রয়াসের বিধান। ওরা ডায়লেশন শেখেনি, ওষুধ বানাতে অক্ষম। ওরা ‘আরক’ শব্দটির অর্থই বোঝে না, শুধু রোগনির্ণয় আর উপশমের জন্য রোগীকে টানাহেঁচড়া করে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যায়। তার পরও রোগীর মৃত্যুসম্ভাবনা শুনি। যেমনটি শুনলাম দিল্লিতে বাংলাদেশি ফুটবলের মৃত্যুসম্ভাবনার সংবাদ।
তাই ‘ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন’ পড়লাম না, দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতাও পালন করলাম না। সম্ভবত আমাদের ফুটবলের বুকে এখনো লাইফ সাপোর্ট লাগিয়ে রাখা হয়েছে, যেন গোপনে বাক্সবন্দী হূদয়। সত্য উদ্ঘাটনে নিজের লজ্জাই বাড়িয়ে তুলছে।
মনে পড়ে, যেন এই সপ্তাহ কয়েক (যদিও ২০০৮ সাল) আগে, বাফুফে লনে প্রতীক্ষারত ফুটবলপ্রেমীরা সালাউদ্দিনের বিজয় সংবাদে ইথারে জোর করতালি দিয়ে বলছে—যাও বাতাস, আকাশকে বলো গিয়ে, সে যেন ভোলে না তূর্যকে (সালাউদ্দিনের ডাকনাম)। আমিও বাসায় ফিরে মনে মনে গুনগুন করলাম: ‘...সুখে থেকো, ভালো থেকো, মনে রেখো এই আমারে’ (আসলে আমারে নয়, সেসব ভোটারকে)।
হ্যাঁ, সেই কমিটির প্রধান, বাফুফের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিটি তাঁর সভাসদ-উপনিষদ নিয়ে তিন-চারটি বছর অতিক্রম করলেন ‘ডিজিটাল ফুটবল’ উপহার দেবেন সেই মন্ত্রে, এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের মধ্যেই বিদেশি কোচ আনলেন চারজন। ব্রাজিলের ডিডো, সার্বিয়ার জোরান জর্জেভিচ, ক্রোয়েশিয়ার রুবচিচ এবং মেসিডোনিয়ার ইলিয়েভস্কি। একমাত্র জর্জেভিচ আমাদের দ্বিতীয়বারের মতো সাফ গেমসের ফুটবলে সোনা এনে দিয়েছিলেন ঢাকার মাঠে, ২০১০ সালে। ব্যস, তূর্যের সূর্যপ্রতাপ এখানেই শেষ। বলা যায়, অস্তমিত। তারপর সব ‘ঝোলের লাউ অম্বলের কদু’ নিয়ে ফুটবলের গল্প আর গালগপেপা!
এই চার বছরের চলমান প্রক্রিয়ায় লাতিন আমেরিকার একজন এবং পূর্ব ইউরোপের তিনজন কোচকে বিদায় করা হলো নানা ঘটনাঘটনে আর নাটকীয়তায়। জর্জ বেস্টের ভাবশিষ্য, ব্ল্যাটারের তরুণ বন্ধু, মেধাবী সালাউদ্দিন কলজেটা ক্ষয় করছেন বাদল রায়, সালাম মুর্শেদী, শেখ আসলামসহ গোটা সভাসদ নিয়ে। নেপাল-মালদ্বীপের কাছেও বাংলাদেশ আজ ‘মাল’।
১৯৭৮ সালে জাতীয় যুবদলের প্রথম বিদেশি কোচ জার্মানির বেকেলহল্ট মুচকি হেসে বলছেন, তোরা তেত্রিশ বছরে ডজন ডজন বিদেশি কোচ এনেও কিছু পারলি না! রায়সাহেব বাজার-রোকনপুরের পঞ্চায়েত কবরস্থানে শুয়ে থাকা কোচ আবদুর রহিম বলছেন—পারলি না। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের কোচ ননীবসাক শ্মশানের ছাই উড়িয়ে বলছেন—পারলি না। স্বদেশি কোচ সাহেব আলী, আনোয়ার হোসেন বলছেন—পারলি না! সেদিনের প্রয়াত সাদেক বলছেন—পারলি না!
ইতিহাসের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে খসে পড়া টিকটিকির লেজও নড়েচড়ে বলছে—পারলি না! ফুটবলে স্মৃতিবাহী আমার ঝাড়লণ্ঠন এখন মুখে কুলুপ আঁটা পাণ্ডিত্যের নিবু নিবু সলতে উসকে বলছে—জ্বলবে না আর তোর বাতি! তোর হলো না! হলোই না!!
জ্যোতিষ্মান অন্ধকারে ক্রীড়াপাগল আমার মৃত বাবার হাড়গোড় নড়েচড়ে বলছে: ‘আমার রুহু অন্য কোনো সৎ শিশুর সঙ্গে মাঠে আসতে পারে, তাকে খুঁজে নিতে হবে। নিমগাছে পেঁচাকেই বেশি মানায়, কুয়াশাময় রাত্তিরে তো বটেই। ওকে তাড়িয়ে দিতেও একটু সময় লাগবে! আপাতত খেলাধুলা নিয়েই লেখালেখিটা বাদ দে! কবিতাই লেখ।’

No comments

Powered by Blogger.