হুবহু-সরকারের কথার সঙ্গে কাজের কোনো মিল নেই

রাজনীতিক হায়দার আকবর খান রনো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য। দেশের সাম্প্রতিক অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন আমাদের সঙ্গে_ খালেদা জিয়া বলেছেন, বর্তমান সরকার ব্যর্থ, দুর্নীতিবাজ সরকার, তাঁবেদার সরকার! কিন্তু আমরা দেখেছি বৃহত্তর এ দুই দল ক্ষমতায় থাকাকালে প্রায় একই প্রতিচিত্র। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে, জনগণের রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে এ দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শ কেমন হওয়া উচিত বলে মনে


করেন? ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসকের পতনের পর পালাক্রমে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে। এ দুটি দলের শ্রেণীচরিত্র এক। বিশেষ করে অর্থনীতিবিষয়ক নীতিতে। দুটি দলই সম্রাজ্যবাদী। তারা মার্কিননীতিতে বিশ্বাসী। তাই যারাই ক্ষমতায় যায় তাদের চরিত্র প্রায় একই হয়ে যায়। তারা জনগণের স্বার্থে কোনো কাজ করে না। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল হিসেবে দাবি করলেও কাজে তা প্রমাণ করে না। তারা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আন্দোলন করলেও তাদের নিয়ে সরকার গঠন করেনি। অন্যদিকে বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে সরকার গঠন করেছে। বিএনপি কট্টর ভারতবিরোধী। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ভারতের প্রতি অনেক নমনীয়। এ দুই দলের মধ্যে মূলত এটুকুই পার্থক্য। দল দুটির আদর্শ এমন হওয়া উচিত, যাতে জনগণ উপকৃত হয়। দেশ থেকে দুর্নীতি দূর হয়। দেশের জনগণ সুখে-শান্তিতে থাকতে পারে। এ ছাড়া স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য তাদের এগিয়ে আসতে হবে।

পরীক্ষামূলক ট্রানজিট দেওয়ার নামে এরই মধ্যে এর ব্যবস্থাপনা চালু হয়ে গেছে। উভয় রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ সফর বিনিময়ের পরও আমাদের প্রাপ্য চাহিদা পানিবণ্টন চুক্তি সুদূর বাতিঘর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রীয় এই ব্যর্থতাকে আপনি কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
এই বিশ্বায়নের যুগে আমি ভারতকে ট্রানজিট না দেওয়ার পক্ষে নই। তবে এটি অবশ্যই সমতার ভিত্তিতে হতে হবে। এখানে দেখতে হবে, আমাদের দেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষা হচ্ছে। ভারত আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই এর আগে ফারাক্কার ওপর বাঁধ নির্মাণ করেছে। এখন তিস্তা নদীর পানিচুক্তি নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারটি খুব স্পষ্ট। কারণ ওরা আপার রিজিওন আর আমরা লয়ার রিজিয়ন বলে। তবে এ বিষয়টির আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাই। ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কও ভালো। তাই তিস্তা চুক্তি নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা হবে_এটাই সবার প্রত্যাশা।

যুগে যুগে শাসকশ্রেণীর হাতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিষ্পেষিত হয়েছে। আবারও পাঁয়তারা চলছে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও গণমাধ্যমের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত?
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান হওয়া উচিত নিরপেক্ষ। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। অন্যদিকে হলুদ সাংবাদিকতাও হয়। এ বিষয়গুলোর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ হবে_এটাই সবার কামনা। আমাদের গণমাধ্যমকেও রাষ্ট্র গঠনে দায়িত্বশীল হতে হবে। তাদের উচিত সুষ্ঠু তথ্যভিত্তিক সংবাদ পরিবেশন করা। নোবেল বিজয়ী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন বলেছেন, দুর্ভিক্ষ ঠেকানোর ক্ষেত্রেও গণমাধ্যমের ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন, দেশপ্রেম জাগ্রত ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। তাই সব কিছু করতে হবে সাংবাদিকতার নিয়ম-নৈতিকা মেনেই।

সৌদি আরবে আট বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ করা হয়েছে, তালিকায় আছেন আরো পাঁচ বাংলাদেশি। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
সৌদি আরবে বাংলাদেশিদের যেভাবে শিরশ্ছেদ করা হলো তা একটি বর্বরোচিত ও নিন্দনীয় ঘটনা। আধুনিক সভ্যতার যুগে কোনো দেশেই এ ধরনের আইন থাকা উচিত নয়। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও এর সমালোচনা করেছে। যেসব বাংলাদেশির শিরশ্ছেদ করা হয়েছে তাঁদের বিচারও আন্তজার্তিক মানদণ্ড অনুযায়ী হয়নি। অভিযোগকারীদের জন্য কোনো উকিল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ওই দেশের ভাষা অনুবাদ করার জন্য ছিল না কোনো অনুবাদক। একটি অন্যায় বিচারের ভিত্তিতে এ ধরনের বর্বরোচিত শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের সরকারও চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ওই সব বাংলাদেশির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ভিত্তিতে দীর্ঘদিন ধরে বিচার চলছিল। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এটি বাংলাদেশ সরকারের একটি বড় ধরনের ব্যর্থতা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংশোধিত হতে যাচ্ছে শিক্ষানীতি। আমাদের শিক্ষানীতি কেমন হওয়া দরকার?
আমরা চাই প্রত্যেক বালক-বালিকা দশম শ্রেণী পর্যন্ত পরিপূর্ণ অবৈতনিক শিক্ষা পাক; কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় নিজ আয়ে চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। কিন্তু দেশের জনগণ হিসেবে আমরা তো সরকারকে ট্যাঙ্ দিই। তাই সরকারের ওই সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। এর ফলে গরিব ছাত্ররা পড়ালেখা করতে পারবে না। সরকার মুখে বলছে তারা গরিব ও জনমুখী শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে চায়; কিন্তু তার কথার সঙ্গে কাজের কোনো মিল নেই। তারা শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ করতে চাচ্ছে। এমনিতেই দেশে তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা বিরাজ করছে। একটি হচ্ছে সাধারণ গরিবদের জন্য, আরেকটি ধনী শ্রেণীর জন্য এবং অন্যটি মাদ্রাসা শিক্ষা। এই মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যেও আবার দুই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। এর একটি কওমি শিক্ষা। অতি দরিদ্ররা এখানে পড়ালেখা করে। এই কওমি শিক্ষা মোটেও যুগোপযোগী নয়। সরকারের উচিত একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আইন সংশোধনের জন্য যে আন্দোলন করেছে সেটির প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। আশা করি শিক্ষনীতি সংশোধন করে সবার জন্য সমান সুযোগ রাখা হবে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণে : সফেদ সিরাজ

No comments

Powered by Blogger.