পাকিস্তান-আগাম নির্বাচনের দাবি_ শাসক মোর্চা মানবে কি? by জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী

মরান খান মনে করছেন, দেশের জনগণ সরকারের পরিবর্তন চাচ্ছে এবং শিগগির নির্বাচন হলে তার সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি। তাই তিনি বলছেন, দেশের ক্রমবর্ধমান সমস্যা নিরসনে প্রয়োজন নতুন নির্বাচন। তিনি মনে করেন, বর্তমান সরকার পররাষ্ট্র ক্ষেত্রসহ সব ব্যাপারেই বিফল হয়েছে। যেহেতু ইমরান কখনও ক্ষমতায় যাননি এবং জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন, সে জন্য তার 'ইমেজ' তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছ। জনগণ তার মধ্যে কিছুটা হলেও আশার আলো


দেখতে পাচ্ছে বর্তমান সময়ে  পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বিরোধী দলগুলো আগাম নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। যদিও তারা এ নির্বাচনকে সরাসরি মধ্যবর্তী নির্বাচন বলতে চাইছে না, তথাপি ভোটপর্বকে বেশ এগিয়ে আনার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে। দেশে ২০১৩ সালে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা। ২০০৮ সালে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতৃত্বে নতুন কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। বেশ কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন সমস্যার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে দেশটির চালচিত্র। একদিকে বেসামরিক এ সরকারের সঙ্গে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান টানাপড়েন, অন্যদিকে বিরোধীদলীয় নেতা ইমরান খানের জনপ্রিয়তায় অবিশ্বাস্য উত্থান পাকিস্তানের রাজনীতিতে বেশ আলোচনার বিষয় করে তুলেছে। প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির হঠাৎ অসুস্থতা ও বিদেশে জরুরি চিকিৎসা এবং শাসক মোর্চার মধ্যে মতের ভিন্নতা সরকারকে বেশ অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এমনি সময়ে বিরোধী দলগুলোর আগাম নির্বাচনের দাবি জোরদার হচ্ছে এবং এখন দেখার ব্যাপার হলো, শাসকগোষ্ঠী এ ব্যাপারে কী কর্মপন্থা গ্রহণ করে। বলাবাহুল্য, সরকারের জন্য এমন দাবিতে সম্মত হওয়াই অস্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি তাই বলেছেন, এ সরকার পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকবে। কিন্তু বিরোধী দল চুপচাপ বসে থাকার অবস্থায় নেই। তাই তারা বলছে, দেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন সরকারের পরিবর্তন এবং সে কারণে আশু নতুন নির্বাচন অপরিহার্য। কিন্তু সেই আগাম নির্বাচনের সম্ভাবনা কতটুকু? সরকার কি এটা মানবে? বিরোধী দল কি সরকারকে এই দাবি মানতে বাধ্য করতে পারবে?
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা মিয়া নওয়াজ শরিফ কিছুদিন আগে আগাম নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু এ দাবিটি নতুন মাত্রা পেয়েছে যখন 'ইনসাফ পার্টির' নেতা সাবেক ক্রিকেট তারকা আশু নির্বাচনের জন্য জোর দাবি জানিয়েছেন। সাবেক অধিনায়ক এবং পাকিস্তানের বিশ্বকাপ বিজয়ের অন্যতম নায়ক ইমরান খানের দল বেশি বড় নয়। পার্লামেন্টেও তাদের অবস্থান ক্ষীণ। কিন্তু কয়েক মাস ধরে ইমরান দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হয়েই যেন আবির্ভূত হয়েছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
ইমরান লাহোর, করাচি যেখানেই যাচ্ছেন, প্রচুর লোকসমাগম হচ্ছে। তিনি লাহোরে এক লক্ষাধিক জনতার উদ্দেশে ভাষণে দেশের সীমাহীন সমস্যার জন্য সরকারকে দায়ী করেছেন। তিনি করাচিতে আরও বড় জনসভায় ভাষণ দেন এবং অধীর জনতার জন্য মধ্যরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং অন্যান্য অঞ্চলেও তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেকেই তার দলে যোগদান করছেন এবং এর মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও আছেন। যেমন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পিপিপি নেতা মেহমুদ শাহ্ কোরেশি ইমরানের সংগঠনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছেন। ইমরান খান মনে করছেন, দেশের জনগণ সরকারের পরিবর্তন চাচ্ছে এবং শিগগির নির্বাচন হলে তার সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি। তাই তিনি বলছেন, দেশের ক্রমবর্ধমান সমস্যা নিরসনে প্রয়োজন নতুন নির্বাচন। ইমরান মনে করেন, বর্তমান সরকার পররাষ্ট্র ক্ষেত্রসহ সব ব্যাপারেই বিফল হয়েছে। যেহেতু ইমরান কখনও ক্ষমতায় যাননি এবং জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন, সে জন্য তার 'ইমেজ' তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছ। জনগণ তার মধ্যে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখতে পাচ্ছে বর্তমান সময়ে।
অন্যদিকে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা নওয়াজ শরিফ আগে দু'বার প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় দুর্নীতি ও অন্যান্য কারণে বেশ সমালোচিত হয়েছেন। তবে সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সময়ে নির্যাতিত হওয়ার কারণে কিছুটা জনপ্রিয়তা ফিরে পেয়েছেন। তার পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) পাঞ্জাবে বেশ শক্তিশালী হলেও সিন্ধু ও অন্যান্য প্রদেশে বেশ দুর্বল।
শাসক পিপিপি সিন্ধুসহ পাঞ্জাবে মোটামুটিভাবে ভালো অবস্থানে থাকলেও দলটির জনপ্রিয়তা বেশ হ্রাস পেয়েছে বলেই মনে করা হতে পারে। এর প্রধান কারণ অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি, যিনি স্ত্রী বেনজির ভুট্টোর নির্মম হত্যার পর সমবেদনার কারণেই মূলত জয়ী পিপিপির রাজনৈতিক কর্ণধার হয়ে আবির্ভূত হন।
উল্লেখ্য, গত নির্বাচনের আগে বেনজির নিহত হন এবং জনপ্রিয় এই নেত্রীর স্বামী হিসেবে পরবর্তী সময়ে জারদারি দেশের প্রেসিডেন্ট হন।
কিন্তু জারদারি তার স্ত্রী বেনজিরের দু'বার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় বড় বড় ব্যবসায় প্রভাব বিস্তারের কারণে 'মি. টেন পারসেন্ট' হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। পরে তিনি দুর্নীতির কারণে দীর্ঘদিন কারাভোগও করেন। ভাগ্য পরে তার প্রতি এতই সুপ্রসন্ন হয় যে, তিনি দেশের ভাগ্যবিধাতা বনে যান এবং প্রেসিডেন্ট আছেন গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে।
পাকিস্তানে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকারে প্রধানমন্ত্রী গিলানি সরকার প্রধান হলেও পিপিপির কার্যকর কর্ণধার হিসেবে জারদারিই ক্ষমতাবান। তবে তার সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানির সমস্যার কারণে তিনি এখন বেশ বিচলিত। কিছুদিন আগে দেশে এবং বহির্বিশ্বে একটি বিষয় নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সেটা হলো প্রেসিডেন্ট জারদারি কর্তৃক মার্কিন উচ্চমহলে একটি বার্তা_ যার মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানে সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থান রোধ করতে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছিলেন। এটা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর থেকে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সঙ্গে জারদারির সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আগে দেশের অভ্যন্তরে আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনের হত্যা নিয়েও দেশের বেসামরিক সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দূরত্ব সৃষ্টি হয়। মার্কিন কমান্ডোদের দ্বারা যখন লাদেন নিহত হন, তখন পাকিস্তান সেই সামরিক মিশন সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিল এবং এটা দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতিও আঘাত হিসেবে পাকিস্তানিরা বিবেচনা করে। সেই নিরাপত্তাজনিত ব্যর্থতার জন্য বেসামরিক সরকার ও সামরিক বাহিনী পরস্পরকে পরোক্ষভাবে দায়ী করে। অবশ্য সেনাবাহিনী প্রধান বলেছেন, দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা নেই। তা সত্ত্বেও, এমনই সম্ভাবনার গুঞ্জন রয়েছে এবং মনে করা হয় সে কারণেই জারদারি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ও দেশে চিকিৎসা না নিয়ে দুবাইয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন।
যাই হোক, বর্তমানের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে পাকিস্তানে যে কোনো পরিবর্তন হয়তো অস্বাভাবিক নয়, তবে বিরোধী দলের আগাম নির্বাচনের দাবি সরকার সহজে মানবে না, এটাই প্রত্যাশিত।

জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী : সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.