শ্রদ্ধাঞ্জলি-স্যামসন চৌধুরী: কাছ থেকে দেখা by ডা. রেজাউল ফরিদ খান

তিনি এলেন, জয়ী হলেন, চলে গেলেন। ৮৬ বছর বয়সে কর্মময়, ত্যাগী, পরোপকারী স্যামসন এইচ চৌধুরী চলে গেলেন। স্কয়ার গ্রুপের ১৯টি প্রতিষ্ঠানের স্রষ্টা, দেশের বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা, সদস্য, বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের প্রাণপুরুষ স্যামসন এইচ চৌধুরী হাতে গোনা কয়েকজনের একজন ছিলেন। বিরল ব্যক্তিত্বের এ মানুষটির দৃঢ়প্রতিজ্ঞা, সততা, কাজের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, বন্ধুসুলভ ব্যবহার আর দেশের প্রতি ভালোবাসার কারণে বাংলাদেশ


তাঁকে 'বিজনেস আইকন' হিসেবে কয়েক বছর আগেই পরিচিতি দিয়েছিল। ১৯৫৮ সালের ছোট্ট স্কয়ার ফার্মাকে কয়েক বছর আগেই দেশের শীর্ষ করপোরেট গ্রুপে পরিণত করেছিল স্যামসন চৌধুরীর মেধা, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা আর মনের অসীম সাহস।
স্যামসন এইচ চৌধুরীর জীবনে অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা ছিল, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাবনার সাঁথিয়ায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন। তিনি যুদ্ধের সময় বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করে স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত গঠনে অবদান রাখেন। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় তিনি নানাভাবে সহযোগিতা প্রদান করেছেন।
বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্ব স্যামসন চৌধুরীর সঙ্গে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল প্রায় পাঁচ বছর। ১৯৯৪ সালে আমি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালের প্রডাক্ট ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার পর শুরুতে আমাকে ডা. খান বলে সম্বোধন করলেও অতি অল্প সময়ে স্যার আমাকে ফরিদ ও তুমি বলতেন। স্কয়ার দেশের এক নম্বর ওষুধ কম্পানি হলেও বিক্রির দিক থেকে কিছু ওষুধ বেক্সিমকো ভালো চলত। তাই স্যারের দৃষ্টিতে বেঙ্মিকো ছিল প্রধান প্রতিযোগী। রেনিটিডিন (নিওট্যাক) ওষুধটি আরো বেশি প্রেসক্রিপশনের জন্য তিনি আমাকে একটা মার্কেটিং পরিকল্পনার কথা বলেন, তার একটা অংশ ছিল ডাক্তারদের কাছে চিঠি লেখা। চিঠিটার ড্রাফট তিনি ৬ বার ঠিক করেছিলেন, বুঝলাম তিনি একজন পারফেকশনিস্ট। শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন, বার্তা অর্থাৎ যাবতীয় বিষয় খুঁটিয়ে দেখতেন। বাংলা, ইংরেজি দুই ভাষাতেই লেখা ও বলায় তিনি ছিলেন পারদর্শী।
'বিজনেস স্ট্যাটেজি' স্যার অত্যন্ত গভীরভাবে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতেন। আমাদের দেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রায় সব ওষুধই বহুজাতিক কম্পানিগুলো প্রস্তুত ও আমদানি করত। ১৯৮২ সালের ওষুধনীতি তৈরি ও প্রণয়নে স্যামসন চৌধুরীর ভূমিকা ছিল খুবই প্রশংসনীয়। ন্যায্যমূল্যে অর্থাৎ কমমূল্যে ওষুধ দেশে তৈরি করে জনগণের কাছে পেঁৗছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসীম। তিনি প্রায় প্রতিদিনই সকালে একবার ডেকে জিজ্ঞেস করতেন আগের দিনের বিক্রি, নির্ধারিত বিক্রি কেন হয়নি। তখনকার সেলস ম্যানেজার সাইফুল সাহেব (বর্তমানে স্কয়ার হাসপাতালের পরিচালক) ও সেলসের অন্যদের সঙ্গে বৈঠক করতেন। সবার মতামত শুনতেন, বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দিতেন। একজন প্রধান হিসেবে তাঁর শোনার ধৈর্য ও যুক্তিখণ্ডন-যুক্তিপ্রদান ছিল ব্যবসায়িক অঙ্ক করে মতামত দেওয়ার মতো।
১৯৯৪-৯৫ সালে স্কয়ারের ব্যবসায়িক বিস্তৃতি ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। টেকনিক্যাল দিক দেখতেন ড. অজয় দেব, মার্কেটিং ম্যানেজার আরশাদুল আলম, মেডিক্যাল ম্যানেজার ডা. সমীর সাহা, এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. আলি রেজা কাদের বখস, ন্যাশনাল সেলস ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম, প্রডাক্ট ম্যানেজমেন্টে আমি, এ ছাড়া আরো কিছু প্রফেশনাল এঙ্পার্ট কাজ করতেন। স্যামসন চৌধুরী স্যার প্রতি মাসেই তিন-চারটি নতুন ওষুধ বাজারজাত করার কথা বলতেন। নিজে বছরে চার-পাঁচবার দেশের বাইরে যেতেন, বিভিন্ন দেশের ওষুধ কিনে আনতেন, লিটারেচারগুলো আমাকে পড়তে দিতেন, ওষুধগুলো ড. অজয় দেবকে দিতেন স্থানীয়ভাবে তৈরির সুযোগ-সুবিধাগুলো দেখার জন্য। দেশের বাইরে যাওয়ার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করতেন নতুন ওষুধের কোনো তথ্য বা অন্যকিছু প্রয়োজন কী না। আমি একবার অ্যানাটমি এটলাস আনতে বলেছিলাম, ওটা এনেছিলেন। অর্থোপেডিকস (অস্থিবিদ্যা), নাক-কান-গলা এগুলোর ছবি পোস্টার আকারে ছাপিয়ে (স্কয়ারের ওষুধের নামসহ) ডাক্তারদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল, যা অনেকের চেম্বারে শোভা পেত।
ডাক্তারদের মাঝে ওষুধের লিটারেচার বিতরণের জন্য বাইরে থেকে প্লেট বানিয়ে আনতে হতো, যা ছিল বেশ ব্যয়বহুল। ডিটিপি মেশিন কেনার ব্যাপারে ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলি, তিনি স্যারের সঙ্গে আলাপ করতে বলেন। স্যার তাঁর জামাতা স্কয়ারে কর্মরত চার্লস পাত্রের সঙ্গে আমাকে নিয়ে আলোচনা করে ডিটিপি মেশিন ক্রয় করেন ও অনেক টাকা সাশ্রয় করেন।
কাজের ক্ষেত্রে যেকোনো সমস্যায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি সব সময়ই সুপরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিতেন। স্কয়ারের যেকোনো ওষুধের নাম চূড়ান্ত করতেন স্যামসন চৌধুরী। তিনি বলতেন, ডাক্তারদের ওষুধের নাম মনে না থাকলে লিখবেন কী করে? তাই কখনো ওষুধের জেনেরিকের শব্দ থেকে নাম নির্বাচন করতেন, সেফট্রাক্সোন থেকে সেফট্রন। ডায়াবেটিক ওষুধের নাম compr D, complication prevention in Diabetes, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের নাম নিয়ে গিয়েছিলাম চার-পাঁচটা, তিনি বললেন, Rex মানে কী_বললাম, যে রাজা রাজত্ব করছেন। আমাকে বললেন, পাশের র‌্যাক থেকে ডিকশনারি আনতে, দুই-তিনটা বই ঘেঁটে বললেন, জবী-ই ফাইনাল। কোনো কাজ নিয়ে অযথা সময় নষ্ট করতেন না, যথাসম্ভব তিনি কাজ সমাধা করতেন।
কাজপাগল স্যামসন চৌধুরী সকাল ৯টার মধ্যে স্কয়ার সেন্টারের ১২ তলায় নিজের চেম্বারে পেঁৗছতেন। পিয়ন আকরাম গ্লাসভর্তি পানি রাখতেন স্যারের টেবিলে, সেক্রেটারি আইজাক দিনের জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্টগুলো জানিয়ে দিতেন। সকালে স্যার আমাকে ডেকে কখনো পাবনা প্লান্টের রব্বানী সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলতেন, কখনো ওষুধের উপাদানের খবর নিতে বলতেন। দুপুরে বাসা থেকে আসা ভাত, সবজি, মাছ, ডাল পরিমাণমতো দুপুর ১টার দিকে খেয়ে নিতেন। দুপুর ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত চেম্বারের পাশের ঘরে বিশ্রাম নিতেন। বিকেলে বিদেশি পত্রিকা বিশেষ করে ফার্মাবিষয়ক, আন্তর্জাতিক ব্যবসাবিষয়ক, দেশীয় পত্রপত্রিকা, কোনো কোনো বিনোদন পাক্ষিকেও চোখ বোলাতেন।
মানবিক গুণে সুসম্পন্ন স্যামসন এইচ চৌধুরী এতিমখানা প্রতিষ্ঠা ছাড়াও বহু সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি কারো চিকিৎসা বা শিক্ষার প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্য করেছেন। কবি ফয়েজ আহমেদ মাঝেমধ্যে বলতেন, স্যার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা দিয়েছেন। দানশীল ব্যক্তিটি পাবনা শহরের বহু লোককে চাকরি, ব্যবসায় সাহায্য করেছেন। তিনি মাঝেমধ্যে বলতেন, আমার ব্যবসার অবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভালো, অন্যদের জন্য কিছু করা আমার দায়িত্ব।
স্নেহপরায়ণ, পিতৃতুল্য স্যারের কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা হলে ওষুধ কিভাবে খেতে হবে জানতে চাইতেন। ১৯৯৫ সালের এক রাতে ১১টায় স্যারের ফোন, ফরিদ তুমি আমাকে একটু দেখে যাবে, একটা ওষুধ খেতে হবে কি না বুঝতে পারছি না। তোমার বাসায় গাড়ি পাঠাচ্ছি। আমি গিয়ে বলার পর আমার হাত ধরে যাওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানালেন। অনিতা ম্যাডাম ফল খেতে দিলেন। ইন্দিরা রোডের বাসায় ঈদের পরদিন বা বড়দিনের আগের দিন বাসায় ফুল নিয়ে গেলে স্যার খুব খুশি হতেন। বিশাল ড্রইংরুমে বসে স্যার রাজনৈতিক, সামাজিক আলাপ-আলোচনা করতেন। পারিবারিক খোঁজখবর নিতেন, তিনি অনেকেরই চাকরি, পেশা, সুবিধাদি আলোচনা করতেন। তাঁর সঙ্গে কর্মকর্তাদের চমৎকার সম্পর্কের কারণে স্কয়ার ফার্মা ছেড়ে কেউ সাধারণত অন্যত্র যেত না। স্কয়ারের চেয়ারম্যান হিসেবে সবাইকে ভালোবাসতেন বলেই কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাজের দিনে দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। উনি বলতেন, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার না খেলে রোগ হতে পারে। স্যামসন চৌধুরীর বিনয়, প্রচারবিমুখতা, সততা ও সদালাপী ব্যবহার বাংলাদেশের ব্যবসাজগতের অনেকেই জানেন। তিনি অত্যন্ত সময় সচেতন ছিলেন, মিটিংয়ের আগেই পেঁৗছতেন সব সময়। বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসনের ওষুধ শিল্প সমিতির বিভিন্ন ফোরামে মূল্যবান বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন বলে দেশের ওষুধ শিল্পের সঙ্গে জড়িত সবারই শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন স্যামসন চৌধুরী।
কাজই ধর্ম, এ নীতিতে বিশ্বাসী স্যামসন চৌধুরী হরতালের দিন সামনের রিকশায় তিনি, পেছনের রিকশায় পিয়ন আকরাম_ইন্দিরা রোড থেকে মহাখালীর স্কয়ার সেন্টার_ঠিকই সকাল ৯টার মধ্যে পেঁৗছে যেতেন। মাঝেমধ্যে শরীর একটু খারাপ থাকলেও এ মানুষটি কাজ করে যেতেন। প্রতিষ্ঠানের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা ও কর্মীদের প্রতি তাঁর স্নেহই আজকের স্কয়ারকে ছোট বিন্দু থেকে বিশাল মহীরুহে পরিণত করেছে।
সাদা মনের মানুষ স্যামসন চৌধুরীকে সব সময়ই রুচিশীল, মার্জিত পোশাকে দেখেছি। স্যুট, ম্যাচিং করে টাই, ব্লেজার পরতেন। কর্মস্থলে বসে অল্প অল্প পানি পান করতেন, পাতলা লিকারের চা, কখনোবা ভেষজ বা হারবাল চা পান করতেন। ধূমপান করতেন না। শরীরের প্রতি যত্নবান ছিলেন, ডাক্তারের পরামর্শমতো ওষুধ খেতেন, চেকআপ করতেন।
আমার চোখের সামনে শিল্পপতি স্যামসন এইচ চৌধুরীর বহু স্মৃতি ভাসছে। আমার কাঁধে হাত রেখে ১২ তলার চেম্বারে যাওয়া, আমাকে কাজের উৎসাহ প্রদান, মেয়ে জুঁইয়ের কথা, জামাতা চার্লস পাত্র, অঞ্জন চৌধুরীর অতিবিলাসিতা, তপন চৌধুরীর হিসেবিভাব, স্বপন চৌধুরীকে কিছুটা কম দায়িত্ব দেওয়া, স্ত্রী অনিতার প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা, বিশ্বাস ও সহযোগিতার কথা বলতেন।
বাংলাদেশের শীর্ষ শিল্পপতি স্যামসন এইচ চৌধুরীকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ দুর্লভ বলেই মনে করি। স্কয়ারকে আজকের অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার পেছনের চালিকাশক্তিটি চলে গেলেন। আমার মতো অনেকেই দুঃখিত, ব্যথিত। স্যামসন চৌধুরীর প্রতি আমাদের সবার বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

লেখক : চিকিৎসক, সাবেক প্রধান প্রডাক্ট ম্যানেজমেন্ট,
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস

No comments

Powered by Blogger.