এক চেয়ারম্যানের নিজস্ব ‘আদালত’ by শাহাবুল শাহীন

প্রতি শনিবার গ্রামটিতে ‘আদালত’ বসে। ওই আদালতে বিচার চাইতে হলে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে আবেদন করতে হয়। বিচারের দিন হাজির না হলে জারি করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। ওই দিন বাদী-বিবাদী দুই পক্ষকে টাকা দিয়ে কথিত ‘আইনজীবী’ নিয়োগ করতে হয়। নইলে বিচার করেন না ‘বিচারক’। বিচারকের নাম গোলাম সাদেক ওরফে লেবু। গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তিনি। ২০১১ সালের ২৭ জুলাই চেয়ারম্যানের


দায়িত্ব নেওয়ার পর সাদেক নিজস্ব নিয়মকানুনে বিচার চালু করেছেন। তিনি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বাকে তাঁর আদালতে আসতে বাধ্য করেছেন। শাস্তি হিসেবে কয়েকজন গ্রামপুলিশকে সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে রাখেন। গ্রামপুলিশদের বাধ্য করেছেন তাঁকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিতে। বাধ্য করেন তাঁর বাড়ি পাহারা দিতে।
চেয়ারম্যান গোলাম সাদেক তাঁর আদালতকে ‘গ্রাম আদালত’ বলতে চান। তাঁর কথা, ‘সাধারণ আদালতের আদলে গ্রাম আদালতের নিয়মানুযায়ী বিচারকাজ সম্পাদন করা হচ্ছে। এতে ইউনিয়নে অপরাধপ্রবণতা অনেক কমেছে।’
গাইবান্ধা সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামুনুর রশিদ বলেন, ‘চেয়ারম্যান, দুজন ইউপি সদস্য ও দুজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে নিয়ে পাঁচ সদস্যের বোর্ড গঠন করে গ্রাম আদালতে বিচারের বিধান রয়েছে। কিন্তু মামলার আবেদন, হাজিরা ও আইনজীবীর ফি নেওয়া ও গ্রামপুলিশকে সূর্যের দিকে দাঁড় করিয়ে রাখা চেয়ারম্যানের এখতিয়ারবহির্ভূত কাজ।’ গ্রাম আদালতে কাঠগড়া তৈরি, মামলার আবেদন, হাজিরা ও আইনজীবীর ফি নেওয়ার কোনো বিধান নেই। তিনি বলেন, এ ধরনের বিচার সম্পূর্ণ আইন পরিপন্থী।
একই কথা বলেন গাইবান্ধার বিশিষ্ট আইনজীবী আনিস মোস্তফা। এ ছাড়া স্থানীয় পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগের নেতারা চেয়ারম্যানের বিচার ও শাস্তিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেছেন।
এ বিচার-প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে তিনটি মামলা হয়েছে।
সরেজমিন: গত ২৪ ডিসেম্বর বিকেলে গিদারী ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে দেখা গেছে, সাধারণ আদালতের মতোই বাদী-বিবাদীর কাঠগড়া। পাশে ‘যাহা বলিব সত্য বলিব, মিথ্যা বলিব না...’ হলফনামার সাইনবোর্ড। চেয়ারম্যান গোলাম সাদেকের পাশে বসেছিলেন আদালতের পেশকার বলে পরিচিত চেয়ারম্যানের সমর্থক সামছুল আলম (৪২)।
ওই সময় ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষে বিচার চাওয়ার আবেদনপত্র লিখছিলেন ‘মুহুরি’ আবদুল মান্নান। ৫০ টাকা ফি দিয়ে তাঁর কাছ থেকে আবেদন লিখে নিতে হয়। তাঁর লেখা ছাড়া কোনো আবেদন বিবেচিত হয় না। এ ছাড়া আবেদন ফি বাবদ ১৫০ টাকা দিতে হয়।
চেয়ারম্যান সাদেক বলেন, ‘গ্রামের মানুষ ঠিকমতো আবেদন লিখতে পারেন না। তাই লেখার জন্য আবদুল মান্নানকে দায়িত্ব দিয়েছি।’
আবেদন করার পর ঠিক হয় বিচারের দিন। নোটিশ দেওয়া হয় বাদী-বিবাদীকে। হাজির না হলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। বিচারের দিন উভয়পক্ষকে ২০ টাকা ফি দিয়ে হাজিরা দিতে হয়। ১০০ থেকে ২০০ টাকা দিয়ে নিয়োগ দিতে হয় কথিত ‘আইনজীবীকে’। নইলে বিচার করেন না বিচারক! এ ছাড়া মামলার অনুলিপি নিতে চাইলে ২০ টাকা দিতে হয়।
গিদারী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মাহবুব আলম, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক তালেব মিয়াজি, গোলজার রহমান ও রেজাউন্নবী আইনজীবীর দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে তালেব মিয়াজিকে এলাকার লোকজন রসিকতা করে ‘অ্যাটর্নি জেনারেল’ বলে থাকেন।
কথিত আইনজীবী গোলজার রহমান বিএ পাস। গোলজার বলেন, ‘গ্রামের নিরীহ মানুষ আদালতে উপস্থিত হয়ে ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। তাই তাঁদের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে আদালতের কাজে সহযোগিতা করছি।’
কথিত আইনজীবীরা বলেন, প্রতি শনিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ১৫ থেকে ২০টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করেন চেয়ারম্যান সাদেক। বেশির ভাগ সালিসে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জরিমানা করা হয়।
তবে মদ্যপান ও জুয়াখেলার অপরাধে মিলন নামের এক যুবকের গলায় জুতার মালা পরিয়ে গ্রাম ঘুরিয়েছেন চেয়ারম্যান সাদেক।
সাদেকের বিরুদ্ধে ১২ ইউপি সদস্য: গিদারী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ইসলাম মিয়া বলেন, ‘বিচার-প্রক্রিয়াসহ কোনো কাজে চেয়ারম্যান আমাদের মতামত নেন না। তাঁর কিছু অনিয়ম তুলে ধরে আমরা ১২ জন ইউপি সদস্য জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন দিয়েছি।’
২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আজগর আলী বলেন, ‘চেয়ারম্যান সাদেক বিচারের নামে মানুষকে হয়রানি করছেন বলে সাধারণ জনগণ আমাদের কাছে অভিযোগ করছেন। কিন্তু আমাদের করার কিছুই নেই।’
এ ব্যাপারে চেয়ারম্যান সাদেক বলেন, ‘ইউপি সদস্যরা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। এ ছাড়া ইউনিয়নে শান্তি ফিরিয়ে আনায় একটি মহল ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছে।’
অভিযুক্তের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে জোর করে হাজির: গত নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে জমি নিয়ে উত্তর গিদারী গ্রামের আবদুস সাত্তারের সঙ্গে তাঁর ভাই করিম মিয়ার ঝগড়া হয়। করিম সাদেকের গ্রাম আদালতে অভিযোগ করেন। কিন্তু মামলার নির্দিষ্ট তারিখে আদালতে হাজির হননি সাত্তার। সাদেক গ্রামপুলিশ পাঠিয়ে সাত্তারের আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী কল্পনা বেগমকে জোর করে ইউনিয়ন পরিষদে হাজির করেন।
এ ঘটনায় কল্পনা বেগম গত ২৪ নভেম্বর গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে চেয়ারম্যান গোলাম সাদেকসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
কল্পনা বেগম বলেন, ‘অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আমাকে ধরে নিয়ে চেয়ারম্যান সাদেক আমার প্রতি অবিচার করেছেন।’
কল্পনার স্বামী সাত্তার বলেন, ‘জমি নিয়ে বিরোধের ঘটনায় দেওয়ানি আদালতে মামলা চলছে। এ কারণে আমি গ্রাম আদালতে যাইনি। কিন্তু এ কারণে আমার স্ত্রীকে ধরে নেওয়া অমানবিক।’
এ ছাড়া দক্ষিণ গিদারী গ্রামের আবদুল মজিদ পারিবারিক ঘটনায় তাঁর ভাই মজিবর রহমানের বিরুদ্ধে গ্রাম আদালতে মামলা করেন। রায়ে মজিবরকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
মজিবর বলেন, তুচ্ছ ঘটনায় চেয়ারম্যান মীমাংসা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বাদীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জরিমানা করেন।
গত ২৯ অক্টোবর দক্ষিণ গিদারী গ্রামের ফারুকুল ইসলাম ও ২৪ নভেম্বর ধুতিচোরা গ্রামের ফরিদা বেগম চেয়ারম্যান গোলাম সাদেকের বিরুদ্ধে গাইবান্ধা মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে দুটি পৃথক মামলা করেন।
ফারুকুল বলেন, ‘একটি ভুট্টার জমি নিয়ে গ্রামের আফজালের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছিল। এ ঘটনায় চেয়ারম্যান সঠিক বিচার না করে আমার ভুট্টাখেত নষ্ট করেন। তাই আমি ওই মামলা করি।’
ফরিদা বলেন, ‘আমার স্বামী আবদুল জলিলের সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব চলছিল। এ ঘটনায় ১২ নভেম্বর গ্রাম আদালতে বিচার শুরু করেন চেয়ারম্যান। একপর্যায়ে দুই পক্ষে উত্তেজনা দেখা দিলে চেয়ারম্যান আমার লোকজনকে মারধর করেন। ফলে আমি মামলা করতে বাধ্য হয়েছি।’
বিবাদীর বাড়িতে ভাত খাওয়ায়: দুই মাস আগে চেয়ারম্যান সাদেকের ‘আদালতে’ করা এক মামলার বিবাদীর বাড়িতে ভাত খান হায়দার আলী, সুকচরণ, মানিক চান ও মতিলাল নামের চারজন গ্রামপুলিশ। এ অপরাধে তাঁদের সূর্যের দিকে এক ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখেন সাদেক। এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য, বিবাদীকে ধরতে গিয়ে তাঁদের বাড়িতে ভাত খেয়ে গ্রামপুলিশেরা অন্যায় করেছেন।
চেয়ারম্যানের বাড়ি পাহারা দেন গ্রামপুলিশ: গোলাম সাদেক ইউপি চেয়ারম্যান হলেও প্রশাসনিক কর্মকর্তার মতো ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন। ইউপির ১০ জন গ্রামপুলিশ পালা করে তাঁর বাড়ি পাহারা দেন। এ ব্যাপারে সাদেক বলেন, অনেক সময় গভীর রাতে মানুষের বিপদ ঘটতে পারে। তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামপুলিশই নিরাপত্তার একমাত্র মাধ্যম। তাই ইউনিয়নের কাজেই রাতে আমার বাড়িতে গ্রামপুলিশ রাখছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামপুলিশেরা বলেন, ‘বাড়ি পাহারাসহ চেয়ারম্যানকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ধমক দেওয়া হয়। ফলে আমরা নীরবে কাজ করে যাচ্ছি।’
অন্যরা যা বলেন: সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফজাল হোসেন খান বলেন, ‘চেয়ারম্যানের এ ধরনের কাজ আইন পরিপন্থী ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এভাবে শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার তাঁর নেই।’
গিদারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুণ-অর-রশিদ বলেন, ‘চেয়ারম্যান সাদেক বিচারের নামে মানুষকে হয়রানি ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন করছেন। মনগড়া নিয়মকানুন চালু করে তা সাধারণ মানুষকে মেনে নিতে বাধ্য করছেন। বিষয়টি প্রশাসনকে জানিয়েও কাজ হচ্ছে না।’
তবে চেয়ারম্যান সাদেকের দাবি, গত চার মাসে ছোট-বড় ২২টি বিবাদের মীমাংসা করা হয়েছে। আদায় করা বিভিন্ন ফি আদালতের কাজে নিয়োজিত লোকজনের বেতনভাতা প্রদান ও ইউনিয়নের উন্নয়নে ব্যয় হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.