ব্লগ থেকে-রাজনীতিতে 'ডাণ্ডাবেড়ি' ও ঘাতক রক্ষার পুনঃপ্রকল্প! by হাসান মোরশেদ

চারদলীয় জোটের রোডমার্চ কর্মসূচি সুন্দরভাবে শেষ হলো। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী আশঙ্কা ছিল, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বাধা দেওয়া হয় কি না। কেন্দ্রীয় না হোক, নিদেনপক্ষে স্থানীয় সরকারদলীয় অতিউৎসাহী কর্মীরা ঝামেলা করলে বড় ধরনের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সূচনা হতো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ধরনের কিছু ঘটেনি। সরকারের পক্ষ থেকে যেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা আসেনি, তেমনি চারদলীয় জোটের আয়োজকরাও এত বড়
আয়োজনে চমৎকার দক্ষতা দেখিয়েছেন। লোক সমাগম, শৃঙ্খলা, আয়োজন_সব কিছু মিলিয়ে বেশ গোছানো উদ্যোগ। হরতাল, ভাঙচুরের বিপরীতে ভালো উদাহরণ, দায়িত্বশীল বিরোধী দলের এ রকমই করা উচিত।
চারদলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা দাবি করছেন, এই রোডমার্চ এবং রোডমার্চ শেষে সিলেট আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে আয়োজিত জনসভা থেকেই মূলত চারদলীয় জোটের সরকারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা ঘটল। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে এই আয়োজনের কিছু ইঙ্গিত বিশ্লেষণ করে শুরু হয়ে যাওয়া সরকারবিরোধী আন্দোলন তথা আসছে দিনগুলোতে রাজনৈতিক চালচিত্রের একটা ধারণা করা সম্ভব হতে পারে। রোডমার্চ কর্মসূচি ও খালেদা জিয়ার জনসভায় লোক সমাগম অত্যন্ত পরিকল্পিত ও গোছানোভাবে সম্পন্ন হওয়ার পেছনে বিএনপির কৃতিত্ব আসলে কতটুকু? বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের মতো দলগুলোয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিত্যনৈমিত্তিক। বড় আয়োজনকে ঘিরে এই কোন্দল আরো প্রকাশ্য হয়ে ওঠে, বিশেষ করে শেখ হাসিনা কিংবা খালেদা জিয়ার সামনে নিজেকে শক্তিশালী প্রমাণ করার জন্য স্থানীয় নেতাদের জোর চেষ্টা থাকেই। সিলেট বিএনপিতেও এ সমস্যা প্রকট।
কিন্তু এবারের আয়োজনে এর কোনো ছিটেফোঁটাও ছিল না। সুন্দর, সুশৃঙ্খলভাবে সব কিছু সম্পন্ন। পাঁচ লাখ মানুষের সমাবেশ হওয়ার পূর্বঘোষণা ছিল, পাঁচ লাখের কম মানুষ উপস্থিত থাকেনি। এর সবটুকু সাফল্য আপাতত জেলা বিএনপির সভাপতি ইলিয়াস আলীর পাতেই যাচ্ছে, যিনি আবার কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। স্থানীয় বিএনপির ইলিয়াসবিরোধীরাও প্রকাশ্যে কোনো বিরোধিতা করার সুযোগ পাচ্ছেন না। কিন্তু শহরে পোস্টার লাগানো থেকে শুরু করে, সভামঞ্চ পাহারা দেওয়া, সভাস্থলের নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনায় জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের অগ্রণী ভূমিকা_সর্বোপরি এ ধরনের বিশাল আয়োজন প্রফেশনাল দক্ষতার ইঙ্গিত দেয়। চারদলীয় জোটের নামে হলেও বিএনপির চেয়ে জামায়াত-শিবিরের জন্য এই কর্মসূচি ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

আরো কিছু ইশারা নজরে আনা যেতে পারে!
সিলেট এসে পেঁৗছার আগে এক পথসভায় খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, 'দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের মা দুর্গা গজে চড়ে এসেছেন। তিনি পূজা অনুষ্ঠানে যে কথা বলেছেন, আমরা জানতে চাই, তিনি আসলে কোন ধর্মে বিশ্বাসী?' বেগম জিয়াকেও নিশ্চয় পালটা প্রশ্ন করা যায়, তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে অন্তত ১০টি দুর্গাপূজায় দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে শুভেচ্ছা জানিয়ে দুর্গাপূজার সফলতা কামনা করেছিলেন কি না? সে সময় খালেদা জিয়ার পরিচয় যদি প্রধানমন্ত্রীর বদলে কেবল একজন কট্টর মুসলমানেরই থাকত তাহলে পূজার সফলতা কামনায় তাঁর ধর্মবিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কি না? পালটা প্রশ্নে কোনো লাভ নেই, বুঝে নিতে হবে একটা ভয়ংকর অসুস্থতা চর্চার শুরু হতে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে যে অসুস্থতার চর্চা অনেকবারই হয়েছে এ দেশে, এই উপমহাদেশে।
সমসাময়িক সময়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'জামায়াতে ইসলামীকে মাঠে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। তারা মাঠে নামলেই তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।' রাজনীতিবিদের ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর জন্য তিনি সরকারের কড়া সমালোচনা করেন।
আলীয়া মাদ্রাসা মাঠের জনসভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী, সাধারণভাবে যিনি সিলেটে জামায়াতবিরোধী বলে পরিচিত। স্বাভাবিক ছাত্রদল থেকে ইলিয়াস আলীর উত্থান যে সময়ে, সে সময়ে সারা দেশেই জামায়াত-শিবিরবিরোধিতায় ছাত্রদলের কর্মীরা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় সমঝোতার খেসারত হিসেবে ধীরে ধীরে ছাত্রদল থেকে সেই জামায়াত-শিবিরবিরোধিতা ধুয়ে-মুছে গেছে। কিন্তু ইলিয়াস আলীও জানেন, সময় পাল্টে গেছে, খালেদাকে গিলে খেয়েছে জামায়াত; সুতরাং খালেদার প্রিয়ভাজন থাকতে হলে জামায়াতের ধামা তাঁকেও ধরতে হবে এবং এই আয়োজনের সফলতার ওপর নির্ভর করছিল তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। সুতরাং জনসভায় খালেদা জিয়ার কাছে তাঁর আবদার, 'বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে বর্তমান সরকারের কিছু মন্ত্রীকেও ডাণ্ডাবেড়ি পরাতে হবে। আওয়ামী লীগে ওসব নেতাকে ডাণ্ডাবেড়ি না পরালে জনগণের দাবি পূরণ হবে না। ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকে ডাণ্ডাবেড়ি পরাতে হবে, তাঁরা হলেন কামরুল ইসলাম, মতিয়া চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরী, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, ফজলে নূর তাপস, ফারুক খান, মাহবুব-উল-আলম হানিফ।' ম্যাডাম জিয়াও আবদার পূরণের আশ্বাস দিয়েছেন যথারীতি।

ডাণ্ডাবেড়ির কাহিনী কী?
পুলিশের ওপর পরিকল্পিত হামলার অভিযোগে জামায়াতের এ টি এম আজহারকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়েছিল কয়েক দিন আগে। দেখা যাচ্ছে, সেই শোকে বিএনপির প্রবল মাতম। যে বার্তা জামায়াত দেওয়ার সাহস পাচ্ছে না, সেই জামায়াতি বার্তা প্রচার হচ্ছে বিএনপির মাধ্যমে।
এদিকে ধীর কিন্তু গোছানো পথে শুরু হয়ে গেছে ঘাতক-দালালদের বিচার প্রক্রিয়া। জামায়াত জানে, একটা মরণ কামড় তাদের দিতেই হবে। একা কিছু করার শক্তি-সামর্থ্য-জনসমর্থন নেই তাদের, কিন্তু বিএনপি তো আছে! বিএনপির জন্য জামায়াত এখন সেই জীবাণুু, যা বিএনপির রক্তমাংস খেয়ে বেঁচে ওঠার চেষ্টা করবে। জামায়াত যদি সাংগঠনিকভাবে এই যাত্রা বেঁচে যায় তাহলে ভবিষ্যতে বিএনপি যাবে জাদুঘরে।
জামায়াতের মরণ কামড় কী হতে পারে? সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর পথ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিয়ে দেশে একটা ভয়াবহ অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করা, যা সরকারের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই গ্রাউন্ডওয়ার্ক শুরু হয়েছে খালেদা জিয়ার সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা দিয়ে এবং হতে পারে পাথরঘাটা একটা ছোটখাটো টেস্ট কেস।
চট্টগ্রামের এক সাংবাদিক বন্ধুর ফেসবুক স্ট্যাটাস শেয়ার করা যেতে পারে_'পাথরঘাটা গঙ্গাবাড়ির দরিদ্র হিন্দুবাড়ির ঘুমন্ত মানুষগুলোর ওপর রাত ৯টার দিকে অতর্কিত এ হামলা নানা রং দিয়ে নানা নামে (সংঘর্ষ, দাঙ্গা, পুরনো শত্রুতা...) প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। বিপন্ন মানুষগুলোর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে একের পর এক বাড়ি। পাথরঘাটা এলাকার নিরীহ জেলেদের ওপর এ বর্বরোচিত হামলা সংঘটিত করেছে এলাকার কাউন্সিলর এবং বিএনপি নেতা ইসমাইল বালি। নিরীহ জেলে পরিবারগুলোকে ভয় দেখিয়ে আক্রমণ করে তাড়িয়ে জায়গা দখল করার হীনস্বার্থে এ ঘটনা। ইনডিপেনডেন্ট টিভির ক্যামেরাম্যান সাজীব গুরুতর আহত। আইসিইউতে ভর্তি। আরো ১০ সাংবাদিক আহত। তাঁদের ওপর হামলার এ দায় কার? র‌্যাব-পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল কেন? ...তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? খতিয়ে দেখা দরকার। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এমন পরিস্থিতি আবার হবে। পরিকল্পিত এ হামলা আবার যদি হয় ধর্মীয় হানাহানির, তাহলে মিথ্যা প্ররোচনা ছড়িয়ে যেতে পারে সারা দেশে, যা সবার জন্য বিপদ ডেকে আনবে বৈকি!'
বিএনপির জন্য শোকার্ত হওয়া ছাড়া নাগরিক হিসেবে আমার আর কোনো পথ নেই। সরকারবিরোধী আন্দোলনের অনেক অনেক এজেন্ডা সরকার নিজে প্রস্তুত করে দিয়েছে_দ্রব্যমূল্য, শেয়ারবাজার, আইনশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, ট্রানজিট, সীমান্ত হত্যা_এর যেকোনো একটিকে ধরেই সরল পথে জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন সম্ভব; কিন্তু বিএনপি সেটা না করে সরাসরিই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করে এখন জামায়ত বাঁচানোর আন্দোলনে।
আওয়ামীবিরোধিতার নামে ১৯৭২-৭৫-এ জামায়াতকে নিরাপদ গর্তে লুকানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে; পঁচাত্তরের পর গর্ত থেকে বের করে এনে পুনর্বাসন করা হয়েছে একই অজুহাতে। এখন যখন জামায়াত আবার বিপদে, আবারও সেই একই অজুহাতে জামায়াত বাঁচানোর দায়টুকু নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছে বিএনপি। জামায়াতকে বাঁচিয়ে শেষ পর্যন্ত বিরোধিতাটা আওয়ামী লীগের নয়, বিরোধিতা করা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাংলাদেশের। কারণ জামায়াত শেষ পর্যন্ত আওয়ামীবিরোধী নাও হতে পারে; কিন্তু নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশবিরোধী ছিল, আছে, থাকবে।

(সচলায়তন.কম থেকে)

No comments

Powered by Blogger.