ঐতিহ্যহীন জাতি!-ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো রক্ষা করা হোক

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়। কারণ, তারা ঐতিহ্যের মর্যাদা বোঝে। তারা নাম-পরিচয়হীন হতে চায় না। সেটা ব্যক্তি পর্যায়ে যেমন সত্য, তেমনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও। বিশ্ববাসীর সামনে তারা গর্বের সঙ্গে তাদের ঐতিহ্যগুলো তুলে ধরে। তারা যে একটি প্রাচীন সভ্য জাতিসত্তার উত্তরাধিকারী, সেটা তারা অহংকারের সঙ্গে বলে বেড়ায়। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য কিংবা রাষ্ট্রীয় পরিচয় তুলে ধরার জন্য তারা ঐতিহাসিক


নিদর্শনগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু আমরা কেমন জাতি? একের পর এক আমরা আমাদের ঐতিহাসিক নিদর্শন ও পুরাকীর্তিগুলোকে ধ্বংস করে চলেছি! গতকাল শনিবারের কালের কণ্ঠ পড়ে আমাদের হতাশা আরো বেড়ে গেছে। বগুড়ার মহাস্থানগড়সংলগ্ন এলাকায় প্রাচীন যেসব নিদর্শন ছিল, সেগুলো দ্রুত ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। ভীমের জাঙ্গালখ্যাত প্রাচীন সুরক্ষা প্রাচীর, শব্দলদীঘির পাড় থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় ইটখোলাগুলো। বরিশাল জজ আদালতটি যে ভবনে অবস্থিত, সেটা শতাধিক বছরের পুরনো দৃষ্টিনন্দন একটি ভবন। সামনে থাকা দীঘিটি নিয়ে এর যে সৌন্দর্য, তা সবাইকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু ভবনটির সেই দৃষ্টিনন্দন রূপটি আর থাকছে না। সেখানে দীঘি ভরাট করে নির্মিত হতে যাচ্ছে ১০ তলা ভবন। আর সেই ভবনের পেছনে থাকা শতবর্ষের পুরনো ভবনটি হয়তো অনাথের মতো আরো কিছুদিন দাঁড়িয়ে থাকবে। তারপর সেই ভবনটিও একসময় ভেঙে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন বানানো হতে পারে, যেমনটি করা হয়েছে পুরান ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় থাকা জেলা পরিষদ ভবনের ক্ষেত্রে। এই তো আমাদের ঐতিহ্যপ্রেম! প্রাকৃতিক ঐতিহ্য তো আমরা অনেক আগেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছি। এখনো যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তাও রক্ষা করা যাবে বলে মনে হয় না। চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বৃহত্তর সিলেটের পাহাড়গুলোও ক্রমেই ধ্বংস করা হচ্ছে। গাছ কেটে ন্যাড়া করে ফেলা হচ্ছে পাহাড়গুলোকে।
কবি জীবনানন্দ দাশ, সুকান্ত ভট্টাচার্য, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জ্যোতিঃপদার্থবিদ মেঘনাদ সাহা, বিপ্লবী সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার, কালজয়ী সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এবং শচীন দেব বর্মণসহ আরো অনেক সূর্যসন্তানের জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশের মাটি। তাঁদের নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। আমাদের পরিচয় ও ঐতিহ্যকে শানিত করতে পারি। তাঁদের স্মৃতিগুলো সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা বিদেশিদের দেখাতে পারি, আমরা ঐতিহ্যহীন নই। আমাদের নতুন প্রজন্মও সেগুলো দেখে উজ্জীবিত হতে পারে। কিন্তু আমাদের সীমাহীন দুর্ভাগ্য যে, ইতিমধ্যে আমরা তাদের ভিটামাটি, স্মৃতিচিহ্ন_প্রায় সবই মুছে ফেলেছি। পাহাড়পুর-মহাস্থানগড়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোও আজ নিরাপদ নয়। সুযোগ পেলেই দখলদাররা হামলে পড়ে। উপযুক্ত সংরক্ষণ প্রচেষ্টা না থাকায় বহু নিদর্শন নষ্ট হয়ে গেছে। ঐতিহাসিক এসব স্থাপনার ভেতরের জিনিসপত্র তো আগেই গেছে। এখন ইট-টেরাকোটাও খুলে নিয়ে যাচ্ছে মানুষ। ঐতিহাসিক নিদর্শন দিনাজপুরের মাতাসাগর সরকারিভাবে লিজ দেওয়া হয়েছিল এবং সেই লিজ সম্পত্তি পরে আবার বিক্রিও করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ঐতিহ্য ধ্বংসের এ ধরনের তৎপরতা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আমাদের নামে মাত্র একটা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ রয়েছে। এর না আছে লোকবল, না আছে সক্ষমতা। ফলে ঐতিহ্য সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ কার্যত নেই বললেই চলে। অপরদিকে, বরাবরই সরকারি দলের সমর্থক এবং প্রভাবশালী হিসেবে কথিত কিছু লোক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আমাদের ঐতিহ্য ধ্বংস করে চলেছে। আমরা চাই, সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নিক। তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।

No comments

Powered by Blogger.