সময়ের কথা-সব ঝুটা হ্যায়? by অজয় দাশগুপ্ত

ওয়ামী লীগ বলছে, আমরা গ্রামে গ্রামে কত কাজ করেছি। কৃষকদের সুবিধা দিয়েছি, গ্রামের চেহারা পাল্টে দিয়েছি। কৃষকরা ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছে। কত নতুন রাস্তা বানানো হয়েছে। শহরের কিছু লোক 'সরকার ব্যর্থ' বললেই তা জনমত জরিপ হয়ে গেল? এ মতের সমর্থক যারা তাদের শুধু বলি, কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, তা ঠিক। কিন্তু এই অ্যাকাউন্টে জমা পড়তে হলে তাকে ধানের ভালো দাম পেতে হয়, পাট-আলুর ভালো দাম পেতে হয়। আবার ধান-আলুর


দাম বেশি হয়ে গেলে যারা এসব প্রতিদিন কিনে খায় তারা রাগ করে কত কথা বলে লোকে। সমকাল দেশের ৬৪ জেলা শহর এবং সাড়ে তিনশ'র বেশি উপজেলার বিপুলসংখ্যক গ্রামের হাজার হাজার লোককে মন খুলে কথা বলার সুযোগ দিয়েছিল। মহাজোট সরকারের তিন বছর শেষ হওয়ার কয়েক দিন আগে পরিচালিত জরিপে ৩২টি প্রশ্ন রাখা হয়। আর দুটি ঘর রাখা হয়েছিল ফাঁকা_ একটিতে লিখতে হবে মহাজোট সরকারের প্রধান সাফল্য, আরেকটিতে প্রধান ব্যর্থতা। অন্য সব প্রশ্ন দিতে হবে পরীক্ষায় এমসিকিউ-এর মতো তিন-চারটি উত্তর থেকে একটিতে টিক মার্ক। বাংলাদেশে শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। একটু-আধটু লিখতে পারা নারী-পুরুষের সংখ্যা অনেক। সমকাল জরিপেও তারা লিখেছেন। আর যারা লিখতে পারেন না, তারা অন্যদের দিয়ে লিখিয়েছেন। আগের কালে চিঠি লিখতে বা পড়তে শিক্ষিত লোক খুঁজে বের করতে হতো। এ নিয়ে অনেক কৌতুকও রয়েছে। এক লোক রাইটারকে তার পুত্রের কাছে লিখতে বলছেন : 'হাতের লেখা খুব বাজে, তুমি কিছু মনে করো না।'
কিন্তু বাংলাদেশে এখন ভিন্ন চিত্র। সমকাল জরিপেও এমনকি প্রায় নিরক্ষররা ভাঙা বাংলায় নিজের মনের কথা লিখেছেন। সরকারের সাফল্য যেখানে যতটুকু আছে তাদের নজর এড়ায়নি। শিক্ষায় অগ্রগতি তারা ঠিক ধরেছেন। দুই বছর আগে সমকাল জরিপে কৃষির ছিল জয়জয়কার। এবারে তা নেই। এটা নিয়ে অনেকের বিস্ময়ও আছে। তবে আমাদের মনে হয়েছে, জিনিসের দামেই চাপা পড়েছে এ সাফল্য। ব্যক্তি মতিয়া চৌধুরীর জীবনযাপন আদর্শ হয়ে আছে। তিনি নিজের আখের গুছান না, অন্যকেও সে অপরাধ করতে দেন না। বাংলাদেশ এখন খাদ্যে অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং এর কৃতিত্ব তাকেও যথেষ্ট দিতে হবে। তবে বাজার থেকে কেবল মানুষ চাল-আটা নয়, আরও অনেক পণ্য কেনে। এবারে শীতকালে ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলু_ এসব অনেক সস্তা। কারওয়ান বাজারের কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী বলেছেন, গত দশ বছরে বাজারে এসব সবজি এত সস্তা ছিল না। চালও এবারে মোটামুটি কম দাম। কিন্তু জরিপে প্রধান ব্যর্থতা লিখতে গিয়ে অনেকেরই মনে হয়েছে_ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। সরকার এ জন্য যত যুক্তি দেয়, মানুষ মানবে কেন? বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে_ সে বক্তব্য আমলে নিতে কেউই রাজি নয়।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের একজনের সঙ্গে একান্তে কথা হচ্ছিল ২০০৬ সালের প্রথম দিকে। তখন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর জোট ক্ষমতায়। বাজারে আগুন। খাসির দাম দিয়ে মুরগি কিনে আনতে হয়, এমন অভিযোগ অনেকের। সংবাদপত্রে প্রতিদিন খবর থাকে দ্রব্যমূল্য ইস্যু নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ তার অনেক মন্ত্রী যতই বলেন, বিশ্ববাজারে দাম বাড়ছে বলেই এমন সংকট_ কেউ তাতে কান দেয় না। আওয়ামী লীগের তরফে যুক্তি দেওয়া হচ্ছিল, ১৯৯৬ সালের জুন থেকে ২০০১ সালের জুলাই পর্যন্ত তারা যখন ক্ষমতায় ছিল, বাজারে সব জিনিস সস্তায় পাওয়া যেত। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় এসে জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জিনিসের দাম কমে_ এটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ওই আওয়ামী লীগের নেতাকে বলেছিলাম, আপনারা যে সময় ক্ষমতায় ছিলেন, তখন বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম কম ছিল। তেল ছিল দারুণ সস্তা। মাত্র ১০ ডলারে এক ব্যারেল অশোধিত তেল পাওয়া যেত। চাল-গম-চিনি সব পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কম ছিল। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর এ বাজার আর আগের মতো সস্তা ছিল না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ফের ১৯৯৬-২০০১ সালের মতো সস্তা বাজার না-ও হতে পারে। যে নেতার সঙ্গে কথা বলছিলাম তিনি যুক্তিবাদী ছিলেন। বিশ্ববাজারের খোঁজখবর রাখতেন। স্বীকার করে নিলেন, সরকার চাইলেই অনেক পণ্যে বিদেশের ওপর দারুণভাবে নির্ভরশীল এই দেশের বাজার সামাল দেওয়া যায় না।
জরিপ চালাতে গিয়ে আমরা সমকালের ৬৪ জেলার প্রতিনিধি এবং সাড়ে তিনশ'র বেশি উপজেলা প্রতিনিধি এবং পাঁচশ'র বেশি সুহৃদ সমাবেশের কর্মীর ওপর ভরসা রেখেছি। তারা যে মানুষের কাছাকাছি আছেন, সেটা জরিপের ফল থেকেই স্পষ্ট। যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিত জরিপ পরিচালনা করে, যারা এ কাজে বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত, তারা একবাক্যে বলেছেন, সমকাল জরিপে বাংলাদেশ কথা বলেছে। এখন তা শোনার দায়িত্ব সরকারের। বিরোধী দলকেও শুনতে হবে তাদের কথা। কারণ সরকার ও বিরোধী দল সবাই বলে, তারা রাজনীতি করে মানুষের জন্য। আর বিভিন্ন দলের নেতারা বলেন, জনগণ এটা চায় এবং এটা চায় না_ তখন তারা এমনভাবে বলেন যে সব মানুষের কথাই তারা বলছেন। কিন্তু জনগণ কি একজোট হয়ে সবার সঙ্গে আছে? সমকাল এবং প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার যে জরিপ চালিয়েছে, তাতে কিন্তু সে কথা বলা যায় না।
তবে রাজনীতি বড়ই কঠিন। যখন বলা হয়, সরকারের জনপ্রিয়তা কমেছে এবং বিএনপির বেড়েছে_ তখন বিএনপি বলে ঠিক কথা, তবে পুরোপুরি ঠিক নয়। বিএনপি যতটা জনপ্রিয় বলা হয়েছে, বাস্তবে তার চেয়েও বেশি জনপ্রিয়। আর শাসক দল আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বলে ওঠেন_ কিছু লোকের কাছে গিয়ে কথা বললেই জরিপ হয় নাকি? আবার সরকারের যেসব সাফল্য সম্পর্কে নারী-পুরুষেরা বলেছে_ সে সম্পর্কে বিএনপি নেতাদের কথা_ আসলে সাফল্যের ভাণ্ডার শূন্য। আবার আওয়ামী লীগ বলছে, আমরা গ্রামে গ্রামে কত কাজ করেছি। কৃষকদের সুবিধা দিয়েছি, গ্রামের চেহারা পাল্টে দিয়েছি। কৃষকরা ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছে। কত নতুন রাস্তা বানানো হয়েছে। শহরের কিছু লোক 'সরকার ব্যর্থ' বললেই তা জনমত জরিপ হয়ে গেল? এ মতের সমর্থক যারা তাদের শুধু বলি, কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, তা ঠিক। কিন্তু এই অ্যাকাউন্টে জমা পড়তে হলে তাকে ধানের ভালো দাম পেতে হয়, পাট-আলুর ভালো দাম পেতে হয়। আবার ধান-আলুর দাম বেশি হয়ে গেলে যারা এসব প্রতিদিন কিনে খায় তারা রাগ করে। সরকার তাহলে কী করবে? এক গল্প আছে_ এক কৃষকের ধানের জমি দিয়ে এক লোক সহজ পথে হাঁটতে গিয়ে ধরা পড়ে কৃষকের হাতে। কৃষক বলে, সামনে এক পা আগাবে না। লোকটি বলে, তাহলে পেছনে ফিরে যাই? কৃষক বলে_ না। লোকটি বলে, তাহলে কী করব? কৃষক বলে_ কিছুই করতে পারবে না। মানুষ সরকারের ওপর বেশি ক্ষেপে গেলে কোনো কাজই পছন্দ হয় না। দ্রব্যমূল্য এমনই একটি ইস্যু। কিন্তু অন্য যেখানে যেটুকু ভালো হচ্ছে, সবাই সেটা স্বীকার করে নিচ্ছে। তাহলে সরকারের জন্য করণীয় দাঁড়ায়_ জনপ্রিয়তা ফিরে পেতে হলে এই ভালো কাজের সংখ্যা বাড়ানো। একবার ভাবুন তো_ পদ্মা সেতুর সব পিলার নয়, কয়েকটাও যদি এই তিন বছরে পদ্মা নদীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াত? এমনটি ঘটলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর কোটি কোটি লোক সরকারকে সাধুবাদ দিত। অনেক ভুল মাফ করে দিত। খুলনার এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দর যতটা দূরে, ঢাকা থেকে মংলা বন্দর ততটা নয়। তবে এটা সত্য হবে কেবল মাওয়া পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শেষ হলে এবং তাতে রেলপথ থাকতে হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ হলে মংলা বন্দর আর হতশ্রী থাকবে না। কিন্তু সরকার এ বিষয়টা বুঝতেই চাইল না। তাদের জন্য বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিপুল অর্থ বরাদ্দ করল, কিন্তু নিজেদের ভুল কিংবা বোকামির জন্য তা হারিয়ে ফেলল। এটা সাময়িক সময়ের জন্য নাকি অনেক বছরের জন্য, কে জানে।
সমকাল জরিপে অংশ নিয়ে যারা মানুষের কাছে গেছে তাদের সাধুবাদ দিতেই হয়। শাসক দলের লোকেরাও কিন্তু এভাবে যেতে পারে। কিন্তু যাবে কি? এখানেই দারুণ সংশয়। নারায়ণগঞ্জে শামীম ওসমান প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর অনেকেই বলছিল, এরপর নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দিতে গিয়ে নিশ্চয়ই বিষয়টি খেয়ালে রাখা হবে। কিন্তু স্বল্প সময়ের ব্যবধানে কুমিল্লায় দেখা গেল, 'ওই জেলার শামীমই' আওয়ামী লীগের পছন্দ। কিন্তু জনগণের হাতে ভোটের অধিকার_ তাই তারা জানিয়ে দিল_ তাদের না-পছন্দ।
একজন সাংবাদিক তিনটি পত্রিকার জরিপ খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন। তার মতে, এতে বাস্তব চিত্র আছে স্পষ্টভাবে। আর তাতে শাসক দলের খুশি হওয়ার কথা। তিনি বলেন, পত্রিকা পড়লে অনেক সময় মনে হয় যে দেশে আইন-শৃঙ্খলা একেবারে ভেঙে পড়েছে। কিন্তু জনগণ বলছে, তারা মোটামুটি ভালো আছে। এমনকি ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্নেও তারা এই মত দিয়েছেন। বিরোধী দলের রোডমার্চের খবর পত্রিকা-টিভিতে দেখে মনে হতো, জনগণ পুরোপুরি বিরোধী দলের পক্ষে চলে গেছে। কিন্তু জনমতে রয়েছে ভিন্ন চিত্র_ জনপ্রিয়তায় সরকার ও বিরোধী দল পরস্পর থেকে বেশি দূরে নয়। এ অবস্থায় দুই পক্ষেরই নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তারা সেটা করবে কি? নাকি বলে চলবে_ সব ঝুটা হ্যায়?
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্র হয়ে উঠেছে_ উইনার্স টেকস অল। সবকিছু তাদের চাই_ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাটবাজার, বাসস্ট্যান্ডে কর্তৃত্ব চাই। সরকারের যত সব কেনাকাটা ও নির্মাণ কাজ তাতে বড় ভাগ চাই। কিন্তু মানুষ এটা মোটেই পছন্দ করছে না। বিএনপি এটা বুঝতে চায়নি। এখন আওয়ামী লীগও বুঝতে চাইছে না। আর জনগণের জন্য সমস্যা হচ্ছে, তাদের সামনে খুব একটা বিকল্প নেই। তাদের জন্য প্রায়শই দুই সন্ত্রাসীর একজনকে বেছে নিতে হয়। এখনও যে প্রতিটি নির্বাচনে তাদের জন্য 'আইভী' নেই।

অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.