ফিরে দেখা ২০১১-এর ক্রীড়াঙ্গন by মেজর চাকলাদার (অব.)

০১১ সালে ঢাকার মাঠে ফুটবলের নন্দিত তারকা লিওনেল মেসি তাঁর আর্জেন্টিনা দল নিয়ে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে খেলে গেলেন। আমাদের প্রায় ৪০ কোটি টাকা ব্যয় হলো। সেই দেশেরই ফুটবল দলটি দিল্লির সাফ গেমসে পাকিস্তানের সঙ্গে ড্র করার পর নেপালের কাছে ১-০ ও মালদ্বীপের কাছে ৩-১ গোলে পরাজিত হয়ে লজ্জাজনকভাবে বিদায় নিল। বিদায় নেওয়ার পরই কোচ নিকোলা ইলিয়েভস্কিকেও পত্রপাঠ বিদায়। সব দোষ কোচের। আমরা দেখেছি, নাসের


হেজাজি, অটো ফিস্টার, জর্জ কোটান, সামির শাকির, ক্রুসিয়ানি, ডিডো—বাংলাদেশের সব ফুটবল কোচেরই একই পরিণতি। কর্মকর্তাদের কোনো ভুল নেই। তাঁরা পদত্যাগ করেন না। কোচদের তো কর্মকর্তারাই পদত্যাগ করান বা ছাঁটাই করে দেন, কর্মকর্তাদের পদত্যাগ করাবে কে?
আমাদের এখন ৪২টি ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন। এত ফেডারেশন নিয়ে তো আর লেখা যায় না। তবে অ্যাথলেটিকস বা সাঁতারে সবার আগে দরকার ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডের মাধ্যমে সময় নিরূপণ করা। আমরা এই আধুনিক যুগেও হ্যান্ড টাইমিংয়ে পড়ে আছি। এটা কি ক্রীড়ামন্ত্রী জানেন? যদি জেনে থাকেন, তাহলে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? আর যদি জেনে না থাকেন, তবে ঠিকই আছে—ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর এত জানতে হয় না। এসএ গেমসের সময় কোটি টাকা ব্যয় করে ইলেকট্রনিক টাইমিং পদ্ধতি চালু হয়েছিল, সেই সরঞ্জামাদিই বা কোথায় গেল?
ক্রিকেটে আমাদের অর্জন সাকিবের টেস্ট ও ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর অলরাউন্ডার হওয়া। এটা ব্যক্তিগত সাফল্য। দলীয়ভাবে আমাদের ক্রিকেট দল যেভাবে পরাজিত হয়, সেটাকে ফুটবল বা হকির গোলে পরিবর্তন করা হলে তা হবে ৮-০ বা ১০-০ গোলে। অথচ এখন আইপিএলের আদলে বিপিএল নামে টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট আয়োজন নিয়ে ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা মহাব্যস্ত। ক্রিকেট খেলার ব্যাকরণে আমরা এত পিছিয়ে যে, এতে খেলোয়াড়দের আরও সমস্যা হবে। ভারতে আইপিএলে ধুমধাড়াক্কা রান উঠছে, অথচ তাদের ব্যাটিং উপমহাদেশের বাইরে লজ্জার পর্যায়ে চলে এসেছে—ক্রীড়াবোদ্ধারা এ দোষ দিচ্ছেন আইপিএলকে। আমাদের ক্রিকেটের গড়ে ওঠার মুহূর্তে এই আইপিএল ধরনের টুর্নামেন্ট খেলোয়াড়দের অর্থবিত্ত এনে দেবে, তবে ব্যাটিং ও বোলিংয়ের মানকে আরও শোচনীয় পর্যায়ে ঠেলে দেবে।
ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন ১৩টি দেশ নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট করেছিল ঢাকায়। আমাদের দেশে খেলা হচ্ছে, আবার আমরাই ওয়াকওভার দিচ্ছি—বিদেশিরা হতবাক। তাদের কথা, ভিসা জটিলতা, বিমানের টিকিট সমস্যা ইত্যাদি কারণে বিদেশিদের না আসার সম্ভাবনা থেকে ওয়াকওভার হতে পারে, কিন্তু এটা কী হচ্ছে? আসল কথা হলো, কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কোন্দলের ফসল হলো এই ওয়াকওভারের ঘটনা। এই ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের সভাপতি হলেন রুবাবা দৌলা। আচ্ছা, দেশের এমন ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার ঘটনায় তিনি কী পদক্ষেপ নিলেন? তিনি কি আগে টের পাননি, এ রকম কিছু হতে পারে? আসলে তিনি ক্রীড়াঙ্গনের মানুষই নন। তাই এ ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। ঠিক কথা। তা হলে প্রশ্ন—ডাকলেই দায়িত্ব নিতে হবে, এটাই বা কেমন কথা? বধির ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতি আবার সুকণ্ঠী মমতাজ। ক্রীড়াঙ্গনের কাউকে বিভিন্ন ফেডারেশনের সভাপতি করার জন্য ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী কবে উদ্যোগ নেবেন?
হকি ফেডারেশনে নতুন কর্মকর্তারা দায়িত্ব নেওয়ার পর খেলা মাঠে গড়িয়েছে। বিজয় দিবস হকি শেষ হলো। সেনাবাহিনীকে ৪-২ গোলে হারিয়ে আবাহনী লিমিটেড বিজয়ী হয়েছে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডান স্পোর্টিংয়ের চারজন খেলোয়াড় আবাহনীর হয়ে খেলেছে। এটা সুখবরই। ক্রীড়ার সংসদীয় কমিটির সভাপতি জাহিদ আহসান রাসেল সাহেব পুরস্কার দিতে এসেছিলেন এবং একটি দুর্দান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিজিত দলটি ছিল সেনাবাহিনী। তিনি তাদের পুরস্কার দিলেন না। সেনাবাহিনী দলের ম্যানেজারকে ডেকে ১৬টি মেডেল দিয়ে দেওয়া হলো। তাঁর যদি এতই ব্যস্ততা থাকে, তবে দুটি দলের জন্যই এক নিয়ম হওয়া উচিত ছিল। এটা একটি দলকে উপেক্ষা করা এবং তাদের যোগ্যতা মূল্যায়ন না করার লজ্জাজনক ছবি। আশা করব, এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ক্রীড়াঙ্গনে ঘটবে না।
জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন দেশে বছর শেষে একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট করেছে। পাশাপাশি এই টুর্নামেন্টে একটি স্বর্ণও পেয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা আর উজবেকিস্তানের ৩২ জন পুরুষ আর ২৪ জন মহিলা জিমন্যাস্টের অংশগ্রহণে উজ্জ্বল হয়েছিল মিরপুরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়াম। সাইক সিজার বাংলাদেশের জন্য একটি স্বর্ণ পেয়েছেন। তাঁকে অভিনন্দন। তবে সাইকের কোচ তাঁর বাবা সিজার আহমেদ। তাঁর ট্রেনিং আর অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে। তাহলে আমাদের দেশের ট্রেনিংপ্রাপ্তদের খবর কী?
মহিলা ক্রিকেট দল ওয়ানডে মর্যাদা পেয়েছে—এটা সুখবর। তবে প্রায় প্রতিটি ফেডারেশনের মধ্যে যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, এ কারণে কোনো খেলাই সেরা পারফরম্যান্স উপহার দিতে পারছে না।
দেখতে দেখতে এই সরকারের তিনটি বছর পার হয়ে গেল। ক্রীড়াঙ্গনে কোনো পরিবর্তন নেই। ২০১২ শুরু হয়েছে। আশা করব, প্রতিমন্ত্রী সাহেব দেশের ক্রীড়াব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কিছুটা সময় ব্যয় করে কী করে সমস্যাগুলোর সমাধান করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করবেন। ৪২টি ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের অন্তত ১০ ভাগ ফেডারেশনের সভাপতি পদে ক্রীড়াব্যক্তিত্বদের বসাবেন, যেটা হবে ক্রীড়াঙ্গনের জন্য একটি মাইলফলক।
লেখক: জাতীয় হকি দলের সাবেক অধিনায়ক।

No comments

Powered by Blogger.