মধুর প্রতিশোধ-৬১ রানেই বিধ্বস্তওয়েস্ট ইন্ডিজ by সঞ্জয় সাহা পিয়াল,

ছুরিটা বোধহয় লুকিয়ে রাখা ছিল। অপেক্ষা ছিল শুধু সময় আর সুযোগের। গতকাল মেঘে ঢাকা চট্টগ্রামে সে সুযোগ পেয়েই ছুরিটা বুকপকেট থেকে বের করল বাংলাদেশ। পাওয়েল এবং পোলার্ডকে আউট করার পর নাসির যেন সেই ছুরি বের করেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ফালাফালা করে ফেললেন। মাঠে থাকা ১১ বাংলাদেশির ধমনী আর শিরা থেকে তখন ঠিকরে বেরিয়ে পড়তে থাকল বিশ্বকাপের সেই কলঙ্কিত '৫৮'। সেদিন এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছেই ৫৮ রানে অল আউট হয়ে বোবা যন্ত্রণায় কেঁদেছিল বাংলাদেশ। ৫ মার্চ সমকালে শিরোনাম হয়েছিল 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে'।


গতকাল সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকেই যখন ৬১ রানে বান্ডিল করে দেওয়া হলো তখন নিশ্চয় বলা যায়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের মঙ্গলদিন ছিল
গতকাল।
যেদিন কলঙ্কের তিলকের ওপর একটি মঙ্গলজ্যোতি এসে পড়ল। 'এখন আর কেউ ৫৮-র কথা বলবে না, বললেও তার আগে আজকের ৬১ রানের কথা বলতে হবে।' ভেতরের তিরতিরে যন্ত্রণাটা বিস্ফোরিত হয়েছিল ম্যাচের পর মুশফিকের। এদিনের ৮ উইকেটে জয়ের ম্যাচটা সিরিজের বাইরে, ক্রিকেটের বাইরে সমর্পিত ছিল। যেখানে প্রতিশোধের আগুন জ্বলজ্বল করছিল মুশফিকের চোখে। নাসিরের রক্তে বইছিল 'আজ সব মাইরা ফালামু, কাইট্টা ফালামু, আজ আমাগো দিন।' সাকিবের চিবুক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির কথা বলছিল। 'জানি না বাংলাদেশিরা এটাকে প্রতিশোধ বলবে কি-না, তবে আমাদের কাছে দিনটা চরম হতাশার। এর ব্যাখ্যা দেওয়ার ভাষা নেই।' লজ্জায় গলা বুজে আসছিল ক্যারিবীয় অধিনায়ক ড্যারেন স্যামির। কারণ এটা ছিল ক্যারিবীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন রান। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৫৪ রানে অল আউট হওয়ার পর এদিনের ৬১ হয়ে থাকল তাদের ক্ষতস্থান।
আসলে সাত মাসের মধ্যেই যে বাংলাদেশ ৫৮ রানের হিসাব কড়ায়-গণ্ডায় মিটিয়ে দেবে, তা বোধহয় ভুলেও ভাবেননি স্যামি। সে জন্যই তিনটি বদল নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন অনেকটা হালকা মেজাজে। ক্যারিবীয়দের এ খামখেয়ালি প্রকৃতিও পছন্দ করেনি। যেখানে ২০ ওভারের কম হলে ম্যাচ পণ্ড হয়ে যাবে, সেখানে সারাক্ষণই মেঘ চোখ পাকিয়ে থাকল; কিন্তু কখনোই ঝরে পড়ল না। এমন একটি ম্যাচের সময় চট্টগ্রাম শহরের অনেক জায়গায় বৃষ্টি ঝরলেও ছিল না সাগরিকার জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের আকাশে। আর সে সুযোগেই প্রতিশোধের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা বাংলাদেশ মাত্র ২২ ওভারেই গুটিয়ে দিল ক্যারিবীয় ইনিংস। সিরিজ শেষের এ ম্যাচটিকে মৃত বলে বাংলাদেশও চারটি বদল নিয়ে মাঠে নেমেছিল; কিন্তু এ ম্যাচই হাত ভরিয়ে দিল ভূমিপুত্রদের। সাকিব তার ক্যারিয়ারসেরা বোলিং করে দেড়শ' উইকেট শিকারের মাইলফলকে পেঁৗছলেন। নাসির হোসেন তার অভিষেক উইকেট শিকার করলেন। এত পাওয়ার মধ্যেও ৩ রানের একটি আক্ষেপ ছিল সবার মধ্যে। 'যখন ৪৮ রানে তাদের ৮ উইকেট পড়ে যায়, তখনই আমি সবাইকে বলেছিলাম, ৫৭ রানের মধ্যে অল আউট করতে হবে। শুভ ভাইকে বলেছিলাম হয়ে যাবে। সাকিব যখন নবম উইকেট ফেলে দেন তখনও মনে হয়েছিল আর দুই রানের মধ্যেই গুটিয়ে দেব; কিন্তু হলো না। অবশ্য যা হয়েছে তাও তো কম হয়নি।' দিন-রাতের ম্যাচ সন্ধ্যাবাতি দিতে দিতে শেষ হয়ে যাওয়ার তৃপ্তি ছিল মুশফিকের চোখে-মুখে।
দিনের শুরুটা হয়েছিল শুভ লক্ষণে। যেখানে টানা চার ম্যাচে টস জিতে মুশফিক ফিল্ডিং বেছে নেন। নতুন বোলার নাজমুলের কাছ থেকে ব্রেক থ্রু পান। ডেনজি হায়াতকে স্লিপে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেই ৬১ রানের অল আউটের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন নাজমুল। এরপরই ভয়ঙ্কর স্যামুয়েলসকে ৫ রানে থাকতেই বিদায় করেন শফিউল। তখন মনে হয়েছিল, ড্যাম্প কন্ডিশনে পেসাররাই চোখ রাঙাবে; কিন্তু ইনিংসের ১২তম ওভারে ২৫ রানে থাকা পাওয়েল আর শূন্য রানে থাকা পোলার্ডকে পরপর দুই বলে ফিরিয়ে দিয়ে চট্টলার গ্যালারিকে বিশ্বকাপের পুরনো হিসাবটার কথা মনে করিয়ে দেন নাসির।
ওয়ানডে ভুলে অন্যরকম এক ম্যাচ হতে থাকে তখন মাঠে; যেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের টার্গেট দাঁড়ায় ৫৮ রান। ৩৬ রানে ৫ উইকেট পড়ে গেছে, এখন যেভাবেই হোক বাংলাদেশকে ১২ রানের মধ্যে বাকি ৫ উইকেট ফেলতে হবে। উইকেটের পাশ দিয়ে মুশফিক স্লিপ, গালি, শর্ট স্কয়ার লেগ, শর্ট লেগ আর সিলি পয়েন্ট দিয়ে ৫৮-র জাল বিছিয়ে দেন। যে জালে এক এক করে শিকার ধরেছেন সাকিব। মাত্র ৫ ওভারে ১৬ রানের খরচে ৫ উইকেটের দখল নিয়েছেন। ম্যাচ শেষে বাংলাদেশি স্পিনারদের স্কোরশিট ছিল এমন, ১০-১-২১-৭। যেখানে তিন স্পিনার মিলে ২১ রানে ৭ উইকেটের দখল নিয়েছিলেন।
বিষ মাখানো ছিল এদিন বাংলাদেশের স্পিনে। ম্যাচ শেষে ৬১-র সমাধিস্থল দেখতে এসেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং উপদেষ্টা ডেসমন্ড হেইন্স। উইকেটের কাছে গিয়েও তিনি উইকেটে সর্বনাশের কারণ জানতে পারেননি। কিউরেটর নিজেও ৬১-র উত্তর দিতে পারেননি। তবে চট্টলার মানুষ বলছেন, এটা একটা রহস্য। যেটা চট্টগ্রামের একান্তই নিজস্ব। 'দেখলেন তো, চট্টগ্রাম কী দিল আমাদের! এটা আমার শহর। এখন থেকে এটা ক্রিকেটের হোলি শহর।' বক্তার নাম তামিম ইকবাল খান। যিনি কি-না এদিন ৬১ তাড়া করতে নেমেও তাড়াহুড়ো করেননি। যেখানে তার সতীর্থ ইমরুল ১১ আর নাফিস শূন্য রানে আউট হয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে তামিম ৩৬ রানে অপরাজিত থেকে মুশফিককে নিয়ে প্যাভিলিয়নে এসেছিলেন কোচ স্টুয়ার্ট ল'কে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে।
'৫৮'কে সমাধি দেওয়ার দিন একটি স্টাম্প হাতে করে নিয়ে এসেছিলেন মুশফিক। 'সবাই শুধু ৫৮ মনে করিয়ে দেয়, এ স্টাম্পটি এখন থেকে আমাকে ৬১ মনে করিয়ে দেবে।' মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও একবার পেছনে ঘুরে তাকালেন মুশফিক। সেদিকে, যেখানে ৫৮-র সমাধি দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট।

No comments

Powered by Blogger.