দ্বিতীয় দফা ধস

দেশের শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ফেরাতে নেওয়া সরকারের সব উদ্যোগই ব্যর্থ। বাজারের স্থিতিশীলতা ফেরাতে গত সোমবার সরকার একগুচ্ছ প্রণোদনা ঘোষণা করলেও তাতে শেষরক্ষা হয়নি। প্রণোদনা ঘোষণার দিন শেয়ারের মূল্যসূচক সামান্য বাড়লেও গতকাল মঙ্গলবার আবারও বড় ধরনের দরপতন দেখল শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা।

বাজার-সংশ্লিষ্টরা এবারের অব্যাহত দরপতনকে মূল্যায়ন করছেন শেয়ারবাজারের দ্বিতীয় দফা ধস হিসেবে। তাঁরা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের চরম আস্থাহীনতাই এবারের ধসের মূল কারণ।
যোগাযোগ করা হলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বাজারে যে ধস নেমেছিল, তা ছিল অনিবার্য। শেয়ার যেভাবে অতিমূল্যায়িত হয়েছিল তাতে ওই ঘটনা প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু এবারের ধস সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত। এর কোনো কারণ ছিল না।’
প্রথম ধসের পর বাজার স্থিতিশীল করতে প্রণোদনা হিসেবে চলতি বছরের বাজেটে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এরপর সূচক সাড়ে পাঁচ হাজারের ঘর থেকে বেড়ে গত ২৪ জুলাই সর্বোচ্চ ছয় হাজার ৭০০ পয়েন্টে ওঠে। এরপর অব্যাহত দরপতনের ধাক্কায় গতকাল সূচক আবার পাঁচ হাজার ৩০০ পয়েন্টে নেমে এসেছে। এ সময়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্যসূচক কমেছে সবমিলিয়ে এক হাজার ৪০০ পয়েন্টের মতো। ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, গতকাল অনেক কোম্পানির শেয়ার ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে।
ফারুক আহমেদ বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। এ কারণে শেয়ার-মূল্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় পর্যায়ে নেমে এলেও তাঁদের দিক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, সরকার বারবার নানা কথা বলে বাজারকে কৃত্রিমভাবে তোলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু চূড়ান্ত অর্থে এসব উদ্যোগে তেমন কাজ হয়নি, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে।
বাজারের স্থিতিশীলতা ফেরাতে গত সোমবার কর সংক্রান্ত একগুচ্ছ প্রণোদনা ঘোষণা করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। একই দিন পুঁজিবাজারকে স্বচ্ছ, দক্ষ ও স্থিতিশীল করতে ছয় সদস্যের ‘উপদেষ্টা পরিষদ’ গঠন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এই কমিটিতে ফারুক আহমদ সিদ্দিকীরও নাম রয়েছে।
এ ব্যাপারে ফারুক আহমদ সিদ্দিকী বলেন, ‘সংবাদপত্রের মাধ্যমে বিষয়টি প্রথম জানতে পারি। যদিও আজ (মঙ্গলবার) আমি একটি চিঠি পেয়েছি, তার পরও বলব, বিষয়টি আগে জানানো উচিত ছিল।’ বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সচিবের সঙ্গে কথা বলবেন বলেও জানান তিনি।
বাজার-পরিস্থিতি: সূচকের ঊর্ধ্বগতির মধ্য দিয়েই গতকাল দিনের লেনদেন শুরু হয়। প্রথম ১০ মিনিটের মধ্যে ডিএসই মূল্যসূচক বাড়ে ৩৮ পয়েন্ট। এরপর প্রায় এক ঘণ্টা সূচক ওঠানামার মধ্যে ছিল। কিন্তু দুপুর ১২টার পর থেকে সূচক টানা পড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত সূচক ১১৬ পয়েন্ট কমে পাঁচ হাজার ৩০৭ পয়েন্টে নেমে আসে। আর লেনদেন নেমে এসেছে মাত্র ২১০ কোটি টাকায়। গত ২০ ও ২৫ জানুয়ারির অস্বাভাবিক লেনদেনকে বাদ দিলে যা ২০০৮ সালের ১৮ ডিসেম্বরের পর সর্বনিম্ন। ওই দিন ডিএসইতে ১৮২ কোটি টাকার লেনদেন হয়।
সরকারের প্রণোদনার পরও দরপতনের কারণ সম্পর্কে বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতেই বিনিয়োগকারীরা আস্থাহীনতায় ভুগছেন। এ অবস্থায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, বাজারের সমস্যা কীভাবে সমাধান করবেন তা তিনি জানেন না। তাঁর এ বক্তব্যের পর বাজারে দরপতন আরও ত্বরান্বিত হয়।
একজন বিনিয়োগকারী বলেন, অর্থমন্ত্রী নিজেই যেখানে জানেন না বাজার কীভাবে ঠিক করবেন, সেখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কীভাবে বাজারের ওপর আস্থা রাখবেন।
বসতে না পারায় অনশন স্থগিত: এদিকে বাজারের অব্যাহত দরপতনের প্রতিবাদে অনশনরত বিনিয়োগকারীদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও দাঁড়াতে দেয়নি পুলিশ। গতকাল বেলা সোয়া একটার দিকে বিনিয়োগকারীরা শহীদ মিনারের সামনে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করতে গেলে পুলিশ ধাওয়া দিয়ে তাঁদের সরিয়ে দেয়। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের প্রচার সম্পাদক মিজানুর রহমানকে আটক করে পুলিশ। পরে অবশ্য তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় সাত দিনের জন্য অনশন কর্মসূচি স্থগিত করেছেন বিনিয়োগকারীরা।
শেয়ারবাজারে অব্যাহত দরপতনের প্রতিবাদে গত রোববার বেলা ১১টা থেকে ডিএসইর সামনে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ। কিন্তু সোমবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে পুলিশ ডিএসইর সামনে থেকে অনশনরত বিনিয়োগকারীদের জোরপূর্বক সরিয়ে দেয়। এ সময় তাঁরা জাতীয় প্রেসক্লাবে অবস্থান নেন। সেখানেও বসতে না পেরে তাঁরা শহীদ মিনারে কর্মসূচি চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পুলিশ সেখান থেকেও তাঁদের সরিয়ে দেয়।
আবার তৎপর সালমান এফ রহমান: বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান বেশ কয়েক দিন দেশের বাইরে ছিলেন। তাই শেয়ারবাজার নিয়ে তাঁর তৎপরতা ছিলনা। যদিও পুঁজিবাজার তদন্ত কমিটি তাঁর ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু দেশে ফিরেই তিনি আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের (বিএপিএলসি) সভাপতি হিসেবে সালমান এফ রহমান গতকাল রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
জানা গেছে, নর্দান পাওয়ার সলিউশনের রূপান্তরযোগ্য বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতেই তিনি সেখানে যান। নর্দান পাওয়ারের অন্যতম উদ্যোক্তা রাজশাহী-৪ আসনের সরকারি দলের সাংসদ এনামুল হক। এ ছাড়া কোম্পানিটিতে বেক্সিমকোরও অংশীদারি রয়েছে। নর্দান পাওয়ারের ইস্যু ব্যবস্থাপক আইসিবির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড।
আইসিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সালমান এফ রহমান সাংবাদিকদের বলেন, পুঁজিবাজারে তারল্য-সংকটের চেয়ে আস্থার সংকটই প্রধান। এ সংকট দূর করতে সরকার ইতিমধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, পুঁজিবাজার নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা রয়েছে।
সালমান এফ রহমান বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) ও বিএপিএলসির পক্ষ থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু সব ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর পাশাপাশি সরকারকেও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট দূর করতে উদ্যোগ নিতে হবে।’

No comments

Powered by Blogger.