ট্রানজিট : সরকারের কথা ও বাস্তবতায় মিল নেই by বিশ্বজিৎ পাল বাবু,

প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান গত সপ্তাহে বলেছিলেন, আগামী মার্চের মধ্যে ট্রানজিট সুবিধা পেতে যাচ্ছে ভারত। নৌ-প্রটোকল চুক্তি নবায়নের সময় এ বিষয় চূড়ান্ত করা হবে। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরায় বর্তমানে মালামাল যাচ্ছে ১৯৪৭ থেকে ২০১২ সালের মার্চ পর্যন্ত হওয়া ওই চুক্তির আওতায়।সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টা থেকে শুরু করে পদস্থ ব্যক্তিরা কয়েক মাস ধরে ট্রানজিট ইস্যুতে এ ধরনের কথাই বলে আসছেন। এমনও কথা হয়েছে, ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ এর বিপরীতে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করে নিতে চায়।


কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সরকারের কথা আর কাজে মিল পাওয়া যাচ্ছে না। পরীক্ষামূলকের পর এবার নিয়মিত ট্রানজিটের মালামাল আশুগঞ্জ নৌবন্দর হয়ে আখাউড়া স্থলবন্দরে যাচ্ছে। নিয়মিত ট্রানজিটের আওতায় ৯টি ট্রাকের প্রতিটিতে সাড়ে ১৭ টন লোহা ভারতের ত্রিপুরায় যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৫টা নাগাদ ট্রাকগুলো আখাউড়া স্থলবন্দরে অবস্থান করছিল।
নিয়মিত ট্রানজিটসংক্রান্ত চিঠি আখাউড়া স্থলবন্দর কর্মকর্তাদের কাছে এসে পেঁৗছেছে। তবে এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে চাইছেন না। পরীক্ষামূলক ট্রানজিটের মতোই নিয়মিত ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশ কোনো ধরনের শুল্ক পাচ্ছে না। উপরন্তু এখন থেকে নিয়মিত ট্রানজিটের ট্রাকের পণ্য বাংলাদেশে খালাস না করে সরাসরি চলে যাবে গন্তব্যে। ফলে বন্দরের বিভিন্ন চার্জ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ।
কোনো আগাম ঘোষণা ছাড়াই নিয়মিত ট্রানজিট চালু হওয়ার খবরে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। তাঁরা বলছেন, এতে আখাউড়া স্থলবন্দরের ব্যবসায় ধস নামবে। অনেকের অভিমত, বিনা শুল্কে বর্তমান অবস্থায় ট্রানজিট চালুর কারণে বরং লোকসান আর ভর্তুকি দিতে হবে বাংলাদেশকে। কেননা এতে সড়কের ক্ষতির পাশাপাশি বন্দরে রপ্তানি কার্যক্রমেও প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া ভারতীয় পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশি ট্রাক ব্যবহারের সুবাদে জ্বালানি তেলে ভর্তুকির সরকারি সুবিধাটাও পেয়ে যাচ্ছে ভারত। জানা গেছে, গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে পরীক্ষামূলক ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট হিসেবে ভারতের ত্রিপুরায় পণ্য পরিবহন শুরু হয়। এর আওতায় ইতিমধ্যে ৭০০ টন পণ্য ত্রিপুরায় চলে গেছে। পরীক্ষামূলক ট্রানজিটের আরো ৩০০ টন পণ্য যাওয়ার অপেক্ষায়।
নিয়মিত ট্রানজিটের প্রথম চালানে মোট ৬২১ টন এমএস ইনগার্ড (কাঁচা লোহা) পণ্য ত্রিপুরায় যাবে। এর আগে এমভি নীলকণ্ঠ নামের একটি জাহাজে কলকাতা থেকে ওই পণ্যগুলো আশুগঞ্জ নৌবন্দরে আনা হয়। বৃহস্পতিবার সেখান থেকে ওই সব পণ্য আখাউড়া স্থলবন্দরে পেঁৗছায়।
প্রস্তুত নয় নৌবন্দর : ট্রানজিটের জন্য আশুগঞ্জ নৌবন্দরে অবকাঠামোগত কোনো সুবিধা নেই। মেঘনা সেতুর পাশে যেখানে ভারতীয় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করা হয়, সেখানে বন্দরের নূ্যনতম সুযোগ-সুবিধা নেই। বালু ফেলে অস্থায়ীভাবে ঘাট নির্মাণ করা হয়েছে। প্রধান সড়কে ওঠার জন্য যেনতেনভাবে একটি সড়ক তৈরি করা হয়েছে। এখানে শুল্ক বিভাগেরও কোনো অফিস নেই। একটি পেট্রল পাম্পে ভাড়ায় বসানো বিআইডাবি্লউটিএর অফিস থেকে এর কার্যক্রম তদারকি হচ্ছে।
কাস্টমের লুকোচুরি : ট্রানজিট পরীক্ষামূলক নাকি নিয়মিত_এ নিয়ে লুকোচুরি খেলছেন কাস্টমস সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা মুখ খুলতে চাইছেন না। ট্রনাজিটের পণ্য পরিবহনে সড়কের ক্ষতিরও আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব বিষয়েও বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। অবশ্য মালামাল পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান ইন্দোবাংলা শিপিং লাইনস লিমিটেডের ম্যানেজার নজীব গতকাল থেকে নিয়মিত ট্রানজিট চালুর বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, পরীক্ষামূলক ট্রানজিটের বাইরে মোট ৬২১ টন পণ্য ত্রিপুরায় যাবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এগুলোর বিপরীতে প্রায় ২৭ লাখ টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে। কাঁচা লোহা নিয়ে ট্রাক সরাসরি ভারতে চলে যাবে বলে স্থল শুল্ক কর্মকর্তা গত সোমবার সন্ধ্যায় আমাকে জানিয়েছেন।'
তবে স্থল শুল্ক কর্মকর্তা সুবাস চন্দ্র কুণ্ডু বলেন, 'পরীক্ষামূলক ট্রানজিট বলে আমাদের কোনো কাগজে কখনো লেখা ছিল না। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারেই ভারতে যাওয়া পণ্যের কোনো শুল্ক আদায় করা হচ্ছে না।' তিনি আরো বলেন, 'আগে আখাউড়া স্থলবন্দর থেকে ভারতীয় ট্রাক এসে মালামাল নিয়ে গেলেও এখন ট্রাক সরাসরি চলে যাবে ত্রিপুরায়। নিয়মিত ট্রানজিটের কোনো চিঠি পাইনি।'
স্থলবন্দরের স্টেশন সুপারিনটেনডেন্ট হামিদুর রহমান বলেন, 'শুল্ক বিভাগে নিয়মিত ট্রানজিটের একটি চিঠি এসেছে। বিষয়টি আমাদের মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। আগে পরীক্ষামূলক চালানের প্রবেশ ফি, অবস্থান ফিসহ বিভিন্ন চার্জ নেওয়া হতো। এখন ট্রাক সরাসরি গেলে এ চার্জও পাওয়া যাবে না।'
আখাউড়া স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন বাবুল বলেন, 'নিয়মিত ট্রানজিটের বিষয়টি বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের জানিয়েছেন। ট্রানজিটে আমাদের আপত্তি না থাকলেও বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। আমাদের সমস্যার কথা লিখিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি।'

No comments

Powered by Blogger.