প্রণোদনা সত্ত্বেও দর পতন অব্যাহত

শেয়ারবাজার চাঙ্গা করার জন্য বেশ কিছু প্রণোদনা ঘোষণার পর গতকালও পুঁজিবাজার ইতিবাচক ধারায় ফেরেনি। সংকটের সমাধান কীভাবে হতে পারে_ এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, এ সংকট সমাধানের উপায় জানা নেই তার। অর্থমন্ত্রীর এ উক্তি শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। বাজার বিশ্লেষকরা বলেন,শেয়ারবাজারের বর্তমান সংকট প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেওয়া থেকেই শুরু। কিন্তু সরকার ও সংশ্লিষ্টরা শেয়ারবাজার এ সংকটের মূল যথাযথভাবে সমাধানের চেষ্টা করছে না।


তারা বলছেন, কেবল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বাজারে ফিরিয়ে আনাই বর্তমান সংকটের সমাধান হতে পারে।সংশ্লিষ্টদের দাবির মুখে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ওপর কর রেয়াত সুবিধা পুনর্বহাল ও লেনদেনের ওপর উৎসে কর হ্রাস করা হলেও বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই_ এমন প্রশ্নের মুখে বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব প্রণোদনা বাজারে ক্রেতা সৃষ্টি করছে না। আর ক্রেতা সৃষ্টি করা না গেলে কোনোভাবেই বাজারের দরপতন ঠেকানো সম্ভব হবে না।
বিনিয়োগকারীদের কর্মসূচি স্থগিত : টানা দরপতনে দিশেহারা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা প্রতিবাদ জানাতে অনশন ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে চাইলেও পুলিশ তাদের কোথাও দাঁড়াতেই দিচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ডিএসই কার্যালয়ের সামনে সংক্ষিপ্ত এক সংবাদ সম্মেলনে বিনিয়োগকারী পরিষদ তাদের আন্দোলন কর্মসূচি সাত দিনের জন্য স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে। ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রশীদ চৌধুরী জানিয়েছেন, আগামী সাত দিনের মধ্যে শেয়ারবাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে তারা ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দেবেন। এদিকে গতকাল সংগঠনের প্রচার সম্পাদক মিজানুর রহমানকে পুলিশ শহীদ মিনার থেকে গ্রেফতার করেছে।
গতকালের বাজার : সরকারের পক্ষ থেকে কর রেয়াত সুবিধা ও বিশেষ পরামর্শক কমিটি গঠনের ঘোষণার পরও গতকাল দেশের উভয় শেয়ারবাজারে ব্যাপক দরপতন হয়েছে। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইতে সাধারণ সূচক কমেছে ১১৬ পয়েন্ট। লেনদেন হওয়া ২৫৮টি কোম্পানির শেয়ারের মধ্যে ২৩৪টিরই দর কমেছে। লেনদেন হয়েছে মাত্র ২০৯ কোটি টাকার শেয়ার। এর আগে গত ২৫ জানুয়ারি সর্বনিম্ন ২০৬ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল।
দরপতন ঠেকানো যাচ্ছে না : তীব্র তারল্য সংকটকে শেয়ারবাজারের অব্যাহত দরপতনের কারণ বলে দাবি করেছেন শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞরা। অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ এর ব্যাখ্যা করে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানতে গিয়ে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের সিংহভাগ বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমান শেয়ারবাজারের সংকটের মূল সেখানেই। তিনি বলেন, বাজারে ক্রেতা না থাকলে যতই প্রলোভন দেওয়া হোক না কেন, তা কোনো ইতিবাচক প্রভাবই ফেলবে না।
প্রায় একই মত পোষণ করেন এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তবে বর্তমান সংকটের মূলে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের অদূরদর্শিতাকে প্রধানত দায়ী করেন তিনি। মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অর্থনীতিতে নানা পর্যায়ে অভিঘাত আসতে পারে। কিন্তু সেসব অভিঘাত মোকাবেলার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন। যদি অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করার মতো যথেষ্ট দক্ষ লোকের অভাব থাকে, যত রকম উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন, কোনো উদ্যোগই কাজ দেয় না। গত ১০ মাসে শেয়ারবাজার সংকট মোকাবেলায় দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি সরকার। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, সংকট মোকাবেলায় কোনো উদ্যোগ নিলে সরকারের ব্যর্থতা প্রমাণ হয় কি-না_ এমন আশঙ্কায় সংশ্লিষ্ট সচেতন মহলেরও পরামর্শ নিতে চায়নি।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি বদলাবে : প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিনিয়োগ বাজার পরিস্থিতি পাল্টানোর একমাত্র পথ। এ ধারণা ব্যাখ্যা করে শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অ্যাডভোকেট হাসান মাহমুদ বলেন, গত ডিসেম্বর থেকে অব্যাহত দরপতনে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সিংহভাগই ব্যাপক লোকসানের মুখে রয়েছেন। যারা মার্জিন ঋণে শেয়ার কিনেছিলেন, এমন বিনিয়োগকারীরা নিজেদের পুরো টাকা হারানোর পাশাপাশি উল্টো মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের কাছে ঋণী হয়ে পড়েছেন। ফলে দিনে দিনে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সক্ষমতা তলানিতে ঠেকছে। এ কারণেই প্রতিদিনই শেয়ারবাজারের লেনদেন কমছে বলে জানান তিনি। ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ আচরণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুসরণ করেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। এক শেয়ারে লাভ করার পর অন্য শেয়ারে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু ক্রমাগত শেয়ার দর কমায় তারা শেয়ার কেনাবেচা করতে পারছেন না। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বিনিয়োগ এলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সব সময়ই দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করে থাকেন। ফলে তারা যে শেয়ার কিনবেন, বাজারে ওই শেয়ার সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি হবে। যা শেয়ারদর বাড়াতে কাজ করবে। আবার শেয়ারদর বাড়লে সব সময়ই নতুন নতুন ক্রেতা সৃষ্টি, তারল্য প্রবাহ বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানোর উপায় :বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনে শেয়ারবাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন আবু আহমেদ। তিনি জানান, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ তাদের দায়ের ৪ শতাংশের নিচে। অর্থাৎ আরও বর্তমান বিনিয়োগের দেড়গুণ পর্যন্ত বিনিয়োগ করার সুযোগ আছে। দেশের অন্তত ৩০টি ব্যাংকের প্রতিটি গড়ে ৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ করার সক্ষমতা রয়েছে। এভাবে দেড় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আসতে পারে বলে মনে করেন তিনি। আবু আহমেদ বলেন, গত বছরের শেয়ারবাজারের থেকে ব্যাংকগুলো যে মুনাফা করেছিল সংশ্লিষ্টদের দাবির মুখে বাংলাদেশ ব্যাংক লভ্যাংশ আকারে তা বণ্টন করতে দেয়নি। কথা ছিল ওই মুনাফা ব্যাংকগুলো পুনরায় বিনিয়োগ করবে। ব্যাংকগুলো কেন বিনিয়োগে আসছে না, তা সরকারকে খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগে ফেরালে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। আস্থার সংকটও কাটবে। এ পর্যায়ে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর মূলধন বৃদ্ধিসহ তাদের নতুন বিনিয়োগ তহবিল সৃষ্টির পথ ধরতে হবে। পরে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ কমালেও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ধকল সামাল দিতে পারবে। এ ছাড়া লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ বাজারে এলে বাজারে উল্লেখযোগ্য তারল্যপ্রবাহ বাড়বে বলেও জানান তিনি। গত বছরও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যথেষ্ট বিনিয়োগ ছিল স্মরণ করিয়ে আবু আহমেদ বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের সম্মিলিত বিনিয়োগই আজকের শেয়ারবাজার সমস্যার প্রধান উপায় হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.