হরমুজ প্রণালি কেন গুরুত্বপূর্ণ? (ভিডিও)

ম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইরানের বিতর্কিত পরমাণু কর্মসূচি বন্ধে দেশটির ওপর নতুন করে অবরোধ আরোপের বিষয়ে প্রস্তাব করেছে। এ নিয়ে ইরান তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছে, তার ওপর আরও অবরোধ আরোপের চেষ্টা হলে তারা বিশ্বে তেল রপ্তানির গুরুত্বপূর্ণ পথ হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেবে। এ ব্যাপারে ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ রেজা রহিমি হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ‘অবরোধ আরও বাড়লে হরমুজ প্রণালি দিয়ে এক ফোঁটা তেলও যাবে না।’


দেশটির নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল হাবিবুল্লাহ সায়েরি বলেন, ‘হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়াটা ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য এক গ্লাস পানি পানের চেয়েও সহজ কাজ।’
ইরানের এমন হুঁশিয়ারির পর যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, হরমুজ প্রণালি বন্ধে ইরানের কোনো ধরনের তত্পরতা সহ্য করা হবে না। হরমুজের মতো একটি আন্তর্জাতিক জলপথে স্বাভাবিক নৌ চলাচলে বাধাদানকারীকে বৈশ্বিক সম্প্রদায় থেকে বের করে দেওয়া হবে।
তো এখন কথা হচ্ছে এই হরমুজ প্রণালি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? কী কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান এ প্রণালির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে? আর ইরানকে কোনো দেশ হুমকি দিলেই দেশটি হরমুজকে কেন তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতে চায়?—এই প্রশ্নগুলোর পেছনে রয়েছে আসলে আন্তর্জাতিক তেল বাণিজ্যে হরমুজ প্রণালির ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান। আর তাই হরমুজের গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের তত্পরতা চলছে। এবার হরমুজ প্রণালি সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়া যাক।
হরমুজ প্রণালি হলো ওমান ও ইরানের মাঝখানে অবস্থিত এক ফালি সরু জলপথ। এ প্রণালি উপসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় তেল উত্পাদনকারী দেশ সৌদি আরবকে ওমান উপসাগর ও আরব সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। জলপথটির সবচেয়ে সরু অংশের দৈর্ঘ্য ২১ মাইল এবং প্রস্থ দুই মাইল।
মার্কিন জ্বালানি তথ্য প্রশাসন কর্তৃপক্ষের মতে, ২০০৯ সালে সমুদ্রপথে তেল বাণিজ্যের ৩৩ শতাংশ হয় হরমুজ প্রণালি দিয়ে। এর আগে ২০০৮ সালে হয়েছিল ৪০ শতাংশ বাণিজ্য।
২০০৯ সালে হরমুজ দিয়ে এক দিনে দেড় কোটি ব্যারেল তেল পরিবাহিত হতো। এ অঞ্চল দিয়ে তেল পরিবহন নির্বিঘ্ন রাখতে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ নিয়মিত পাহারা দিচ্ছে।
হরমুজ প্রণালি দিয়ে পরিবাহিত তেলের বেশির ভাগই যায় এশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। জাপান তার আমদানিকৃত তেলের তিন-চতুর্থাংশ হরমুজের ওপর দিয়ে নিয়ে যায়। আর চীনের আমদানিকৃত তেলের অর্ধেকই আসে হরমুজ প্রণালি হয়ে।
হরমুজ দিয়ে প্রতিদিন ২০ লাখ ব্যারেলের মতো তেলজাতদ্রব্য রপ্তানি হয়ে থাকে। এর সঙ্গে আছে তরলীকৃত গ্যাসও।

তেল পরিবহনের বিকল্প পথ
সংযুক্ত আরব আমিরাত হরমুজ প্রণালিকে পাশ কাটিয়ে তেল পরিবহনে সক্ষম এমন একটি পাইপলাইন নির্মাণ করছে। আবুধাবিভিত্তিক এই প্রকল্পের পাইপের মাধ্যমে প্রতিদিন ২৫ লাখ ব্যারেল পর্যন্ত অপরিশোধিত তেল পরিবহন করা যাবে।
এ ছাড়া এর আগে সৌদি আরবের ওপর দিয়ে ইরাক থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রতিদিন ১৫ লাখ ব্যারেলেরও বেশি তেল পরিবহন করা হতো। লেবাননে পরিবাহিত হতো প্রতিদিন পাঁচ লাখ ব্যারেল তেল। সৌদি আরবে অপরিশোধিত তেল পরিবহনের জন্য ব্যবহূত পাইপলাইনটির নাম পেট্রলাইন বা ইস্ট-ওয়েস্ট পাইপলাইন।
রয়টার্স জানায়, আশির দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধের মতো এবারও হরমুজে ইরান ‘মাইন’ পুঁতে রাখতে পারে। অবশ্য মার্কিন পঞ্চম নৌবহর (বাহরাইনভিত্তিক) উপসাগরীয় অঞ্চল, লোহিত সাগর, ওমান উপসাগর ও ভারত মহাসাগরের কিছু অঞ্চলে তেলবাহী জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সজাগ দৃষ্টি রাখছে।
মার্কিন পঞ্চম নৌবহরে ১৫ হাজার সেনাসহ ২০টিরও বেশি জাহাজ, জল ও স্থলে পারদর্শী বিশেষ সেনা, জঙ্গিবিমান ছাড়াও রয়েছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অন্যান্য সহায়ক ইউনিট।
অন্যদিকে ২৩টি ডুবোজাহাজ ও ১০০টির মতো টহল জাহাজ নিয়ে ইরানের নৌবাহিনী গঠিত। বিশ্লেষকেরা বলছেন, অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে ইরান কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের সমান হবে না। কিন্তু, গতানুগতিক কৌশলের বাইরে গিয়ে দেশটি ছোট জঙ্গিবিমান নিয়ে মার্কিন নৌবহরে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে পারে। এ ছাড়া ইরান এ অঞ্চলে তার মিত্রদের ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের স্বার্থে আঘাত হানতে পারে।

ঘটনাবহুল হরমুজ
১৯৮৮ সালে হরমুজে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ভিনসেন্স থেকে গুলি করে ইরানের একটি যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করা হয়। এতে বিমানের ২৯০ জন যাত্রীর সবাই নিহত হয়। ওয়াশিংটন বলেছিল জাহাজের ক্রুরা ইরানের ওই বিমানটিকে জঙ্গিবিমান ভেবে ভুল করে ওই হামলা চালায়। অন্যদিকে তেহরান বলেছিল, ইচ্ছাকৃতভাবে মার্কিন বাহিনী ওই হামলা চালিয়েছে।
২০০৮ সালে ইরানের টহল জাহাজগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র তার যুদ্ধজাহাজের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে দাবি করে। ওই টহল জাহাজগুলো মার্কিন যুদ্ধজাহাজের পাশ ঘেঁষে চলাচলের চেষ্টা করে। একই বছর ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রধান মোহাম্মদ আলী জাফরি বলেছিলেন, হামলার শিকার হলে ইরান উপসাগরীয় অঞ্চলের তেল বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ রুট বলে বিবেচিত হরমুজ ও পারস্য উপসাগরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করবে।
২০০৮ সালের জুলাই মাসে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির প্রতিনিধি আলী সিরাজি বলেন, ‘ইরানে হামলা চালানোর জন্য ইহুদি সরকার হোয়াইট হাউসকে চাপ দিচ্ছে। আর হোয়াইট হাউস এ ধরনের বোকামি করলে পারস্য উপসাগরে অবস্থানরত তেলআবিব ও যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হবে।’
২০১০ সালের নভেম্বর মাসে হরমুজ প্রণালিতে প্রথমবারের মতো জঙ্গিদের হামলার শিকার হয় জাপানের একটি তেলবাহী জাহাজ। রয়টার্স অবলম্বনে।

No comments

Powered by Blogger.