বৈশ্বিক রেকর্ডের প্রতিফলন স্থানীয় বাজারে-স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৩০% by শুভংকর কর্মকার

বিদায়ী ২০১১ সালে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দর স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। বছরজুড়ে ইউরোপের অভিন্ন মুদ্রা ইউরো নিয়ে সংকট, বড় বড় শেয়ারবাজারে বড় ধরনের টালমাটাল অবস্থা আর অব্যাহত মূল্যস্ফীতির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যখন একটা অনিশ্চিত সময় অতিক্রম করেছে, তখন নিরাপদতম বিনিয়োগ হিসেবে স্বর্ণের দিকেই ঝুঁকে পড়েছেন অনেকে। ফলে বেড়ে গেছে স্বর্ণের চাহিদা, যা অনিবার্যভাবে বাড়িয়েছে দাম। শুধু স্বর্ণই নয়, রুপার দামও বেড়েছে


রেকর্ড পরিমাণ। বিশ্ব স্বর্ণবাজারের গতি-প্রকৃতির প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বাজারেও। গত জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ১৬ দফায় স্বর্ণের দর বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। ভালো মানের স্বর্ণের দর ভরিপ্রতি এখন ৫৪ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশে স্বর্ণ বেচাকেনার বিষয়টি মূলত স্বর্ণালংকারের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দর যেখানে বহুলাংশে ধাবিত হয়েছে ফাটকাবাজির (স্পেকুলেটিভ) মাধ্যমে, সেখানে বাংলাদেশে বিশ্ববাজারের সঙ্গে দর সমন্বয় করাটাই ছিল প্রধান বিবেচ্য। অথচ স্বর্ণের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ায় মধ্যবিত্তরা বিয়েশাদি ছাড়া স্বর্ণ কেনা থেকে এ রকম বিরত রয়েছেন। বেচাকেনা কমে যাওয়ায় অনেক স্বর্ণ ব্যবসায়ী ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। স্বর্ণ কারিগরদের পেশা বদলের প্রবণতাও বেড়েছে।
স্থানীয় বাজারে বর্তমানে ভালো মানের ২২ ক্যারেট স্বর্ণের ভরিপ্রতি (১১.৬৬৪ গ্রাম) মূল্য ৫৪ হাজার ৮৩২ টাকা। এ ছাড়া ২১ ক্যারেট প্রতি ভরি ৫২ হাজার ৪৮৮ টাকা ও ১৮ ক্যারেট ৪৪ হাজার ৯৬৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর সনাতনী হিসেবে পরিচিত দেশি স্বর্ণের ভরি ৩৩ হাজার ৮২৫ টাকা।
স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রতি ভরি স্বর্ণের গয়না কিনতে ক্রেতাকে এখন গড়ে মজুরি হিসাবে চার হাজার টাকা এবং মূল্য সংযোজন কর হিসেবে আরও দুই শতাংশ হারে অর্থ দিতে হয়। সেই হিসাবে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের গয়নার দর পড়ছে প্রতি ভরি প্রায় ৬১ হাজার ১৮৫ টাকা।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম দিকে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম ছিল প্রতি ভরি ৪২ হাজার ১৬৫ টাকা, ২১ ক্যারেট ৪০ হাজার ২৪০ টাকা, ১৮ ক্যারেট ৩৫ হাজার ৮৬৬ টাকা ও সনাতনী ২৭ হাজার ৫২৭ টাকা।
এই দর বিবেচনায় নিয়ে হিসাব করলে দেখা যায়, চলতি বছরের ১২ মাসে ভরিপ্রতি স্বর্ণের দর সর্বমোট ১২ হাজার ৬৬৭ টাকা বেড়েছে।
সর্বশেষ ১৬ নভেম্বর ভালো মানের স্বর্ণের দর ভরিপ্রতি এক হাজার ২৪৩ টাকা বাড়ে। অবশ্য এরপর ২৩ নভেম্বর ও সর্বশেষ ২০ ডিসেম্বর দুই দফায় ভরিপ্রতি সর্বমোট দুই হাজার ৪৪৪ টাকা দর কমেছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক বছরে স্বর্ণের দর ১৬ বার বেড়েছে এবং কমেছে মাত্র সাতবার। এর মধ্যে গত আগস্ট মাসে সর্বোচ্চ ছয় দফা স্বর্ণের দর ওঠানামা করে। তবে যে হারে লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ে, কমে খুবই অল্প হারে।
গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ভালো মানের স্বর্ণের দাম সর্বোচ্চ হয়। ওই সময় ২২ ক্যারেট প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ৫৯ হাজার ৪৯৪ টাকা, ২১ ক্যারেট ৫৭ হাজার ২১১ টাকা, ১৮ ক্যারেট ৪৯ হাজার ৮০৫ টাকা ও সনাতনী ৩৭ হাজার ৫৫৮ টাকা হয়।
মূলত বিশ্ববাজারে সেপ্টেম্বর মাসে স্বর্ণের দর রেকর্ড বৃদ্ধি পায়। ৬ সেপ্টেম্বর কমোডিটি এক্সচেঞ্জ মার্কেটে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দর এক হাজার ৯২৩ ডলার ৭০ সেন্টে উন্নীত হয়। প্রতিবেশি ভারতে নভেম্বর মাসে স্বর্ণের দর ২৯ হাজার রুপি অতিক্রম করে যায়। অবশ্য বছর শেষে তা কিছুটা নিম্নমুখী হয়। ভারতে এক বছরে স্বর্ণের দর গড়ে প্রায় ৩৪ শতাংশ বেড়েছে।
বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের চাহিদা ও দাম বাড়ায় স্থানীয় বাজারে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তা না হলে প্রতিবেশি দেশগুলোতে অবৈধ পথে পাচার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
আমিনুল ইসলাম আরও বলেন, ডলারের দাম বাড়ায় স্বর্ণের বাজার অস্থির। ডলারের দাম বাড়লে স্বর্ণের দাম আবার বাড়বে বলেও জানান তিনি।
একাধিক স্বর্ণ ব্যবসায়ী বলেন, আগে অনেকেই ৫০০-১০০০ টাকায় স্বর্ণের অলঙ্কার উপহার হিসেবে দিতে পারতেন। কিন্তু স্বর্ণের দাম অস্বাভাবিক বাড়ায় ১০ হাজার টাকার নিচে এখন কোনো গয়না পাওয়া যায় না। ফলে বিয়েশাদি ছাড়া স্বাভাবিকভাবে এখন আর কেউ গয়না কিনতে আসেন না।
ব্যবসায় মন্দা দেখা দেওয়ায় সম্প্রতি বায়তুল মোকাররমে একাধিক ও নিউ মার্কেটে একটি শোরুম বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই এ রকম বন্ধ হওয়ার খবর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা শহর থেকে আসছে বলেও নিশ্চিত করেন বাজুসের সাধারণ সম্পাদক।
বাজুসের সভাপতি দিলীপ রায় প্রথম আলোকে বলেন, টানা দাম বাড়ায় স্বর্ণশিল্প এখন চরম দুরবস্থায়। কেবল বড় ব্যবসায়ীরা টিকে আছেন। গত কয়েক বছরে প্রায় ৫০ শতাংশ স্বর্ণ ব্যবসায়ী তাঁদের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।
দিলীপ রায় আরও বলেন, দেশে কোনো স্বর্ণ নীতিমালা নেই। ফলে বাধ্য হয়ে ‘লাগেজ পার্টি’ দিয়েই আমদানি করতে হয়। এতে গড়ে প্রায় তিন দিন সময় লাগে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে বা কমলে তাৎক্ষণিকভাবে কিনতে পারলে ব্যবসায়ী ও ক্রেতা উভয়েই লাভবান হতেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.