প্রথম শ্রেণীর চাকরি পেল একাত্তরের শিশুঃ ভানুমতির খেল চলছে প্রশাসনে

পৌরাণিক উপাখ্যানে বর্ণিত দৈব ঘটনা ছাড়া চার-পাঁচ বছরের কোনো শিশুর রাজকার্য তথা সরকারি দায়িত্ব পালন করার নজির নেই। এ বয়সে একটি শিশু অ আ ক খ শেখার চেষ্টা শুরু করে। বড়জোর মা-বাবার হাত ধরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়। অথচ সেই চিরায়ত জৈবিক সত্যকেও এবার পাল্টে ফেলা হয়েছে। স্বয়ং আইন মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এ ধরনের এক আশ্চর্য উপাখ্যানের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। জানা গেছে, ১৯৭১ সালে যে শিশুর বয়স ছিল মাত্র চার বছর সাড়ে চার মাস, তাকেও মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া এই তালিকায় নাম লিখিয়ে প্রথম শ্রেণীর পদে চাকরি পেয়েছেন এমন লোক, যিনি মাত্র ২০ বছর বয়সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন! শৈশবে সরকারি চাকরি এবং অবিশ্বাস্য কম বয়সে ডিগ্রি অর্জন নিয়ে স্বভাবতই নানা ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বিভিন্ন মহলে।
জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের ৩৮ বছর পরও মুজিবনগর সরকারের কর্মচারীদের সরকারি তালিকা শেষ হয়নি। অর্থাত্ এখনও নতুন করে নাম অন্তর্ভুক্তির কাজ চলছে এই তালিকায়। এদিকে এতে নাম লেখানো নিয়ে চলছে ভানুমতির খেল, লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য। এর আগে তালিকাভুক্ত যে ১২৬ জনকে গত ৭ নভেম্বর সাব-রেজিসল্ট্রার পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তা নিয়েই দেখা দিয়েছে নানা সংশয়। এই নিয়োগের পরই বেরিয়ে এসেছে থলের বেড়াল। প্রাপ্ত তথ্যমতে, সাব-রেজিসল্ট্রার পদে যোগদানকারীদের মধ্যে এমন দুজন রয়েছেন ১৯৭১ সালে যাদের একজনের বয়স ছিল ৪ বছর সাড়ে ৪ মাস এবং অপরজনের ৫ বছর ৭ মাস ১৩ দিন। এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে এবং পদায়নের সময় ভালো জায়গায় পোসিল্টং পেতে আইন মন্ত্রণালয়ে মোটা দাগের অর্থ-স্বার্থের বিনিময় হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কেন এবার আলোচ্য তালিকা অনুযায়ী সাব-রেজিসল্ট্রার নিয়োগে অতীতের নিয়ম-কানুন মানা হলো না। নিয়ম অনুযায়ী এ পদে যোগদান করতে হলে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। অথচ পরীক্ষা ছাড়াই ৪০ কার্যদিবস প্রশিক্ষণের রেওয়াজ ভেঙে মাত্র ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ কোর্স করিয়ে পদায়ন সম্পন্ন করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও ঘটেছে অঞ্চলপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতির ঘটনা। জানা গেছে, যে ১২৬ জন সাব-রেজিসল্ট্রার পদে যোগদান করেছেন তাদের মধ্যে ২১ জনই কুড়িগ্রাম জেলার। এর নেপথ্যে ছিলেন জনৈক কুড়িগ্রামবাসী পদস্থ কর্মকর্তা। এতসব ঘটনার পর তার ফলাফল যে উত্তম হবে না তা সহজেই বোধগম্য। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট অনেকে সাব-রেজিসল্ট্রারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বিভাগীয় কাজের গতি এবং দক্ষতা কমে যাওয়ার ব্যাপারে সংশয় পোষণ করেছেন। উল্লেখ্য, এর আগে আশির দশকে মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে চাকরিতে যোগদানকারীদের বেলায়ও সংশ্লিষ্ট অনেকে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৭১ সালে যে শিশুর বয়স ছিল চার-পাঁচ বছর সে শিশু মুজিবনগর সরকারের কোন পদে যোগ দিয়েছিল? রেজিসেল্ট্রশন অধিদফতরের জনৈক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তালিকা অনুসারে তারা প্রায় সবাই চাকরি করেছেন ইনফরমার হিসেবে। এ ধরনের তথ্য দেয়ার পর আর বলার অবকাশ থাকে না যে, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।’ এদিকে বর্তমানে সাব-রেজিসল্ট্রার পদে যোগদানকারীদের অনেকেই অবিশ্বাস্য রকমের কম বয়সে অর্থাৎ মাত্র ২০ বছর বয়সে কী করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পেলেন তাও রীতিমত বিস্ময়কর। এসব তথ্য থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, মুজিবনগর সরকারের কর্মচারীদের তালিকা প্রণয়নে নীতি-নিয়মের নিকুচি করা হয়েছে। চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রেও ঘটেছে তারই পুনরাবৃত্তি। প্রশাসনের রন্ব্দ্রে রন্ব্দ্রে যে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে এ ঘটনা তারই আরেকটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। এ ব্যাপারে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে দৈনিক আমার দেশ-এ ৮ নভেম্বর।
অর্থ-স্বার্থের বিনিময়ে এ ধরনের জাল-জালিয়াতি আমাদের দেশে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এমনকি ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ পাল্টে ফেলার মতো ঘটনাও অহরহই ঘটছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও মিথ্যার বেসাতি কম হয়নি। আমরা মনে করি, মুজিবনগর সরকারের কর্মচারীদের তালিকা ও পদায়ন নিয়ে এ ধরনের জালিয়াতি সে সময়ে যারা সেখানে আসলেই কর্মরত ছিলেন তাদেরকে চূড়ান্তভাবে অপদস্থ করার শামিল। এ ব্যাপারে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেবে—এটাই কাম্য।

No comments

Powered by Blogger.