লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে-সাক্ষাৎকার by তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম

মকাল : তিন বছরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে কী সাফল্য রয়েছে? ড. তৌফিক-ই-ইলাহী : নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল ২০১১ সালে ৫ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০১৩ সালে সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। এই মানদণ্ডে আমরা শতভাগ সফল হয়েছি। ইশতেহারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আমরা আরও বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করার চেষ্টা চালাচ্ছি। গ্যাসের উৎপাদনও বেড়েছে। আর কিছু কারিগরি কারণে নতুন করে কোনো কয়লা খনি উন্নয়নে সরকার আগ্রহ


দেখাচ্ছে না। সমকাল : ব্যর্থতা কী? ড. তৌফিক-ই-ইলাহী : এটা আপনারাই ভালো বলতে পারবেন। আরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারলে খুশি হতাম। আরও অনেক করার ছিল। সেগুলো পারিনি_ এটাই ব্যর্থতা বলতে পারেন।
সমকাল : ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি অতি নির্ভরতা সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন কি?
ড. তৌফিক-ই-ইলাহী : রেন্টাল ছাড়া উপায় ছিল না। দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের পর আমরা দুই পায়ে তিন স্টেজে (ধাপে) বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিই। 'দুই পা' মানে সরকারি-বেসরকারি। আর তিনটি স্টেজ হলো স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি। আমরা দুই পায়ে চলছি। আর স্বল্পমেয়াদে কিছু সংকট মোকাবেলা করতে হচ্ছে। মধ্যমেয়াদে আমরা এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসব। আর দীর্ঘমেয়াদে একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত হবে। আমরা একসঙ্গে এসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্প সরকারের নিজের টাকায় কোনো দিন হয়নি, যেটা এই সরকার করেছে। নয় মাসের মধ্যে সরকার এক বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ৮৫০ মেগাওয়াটের পিকিং প্লান্ট প্রকল্প গ্রহণ করেছে। নয় মাসের মধ্যে সরকার প্রকল্প তৈরি করে পিপিআর মেনে দরপত্র আহ্বান করে ঠিকাদার চূড়ান্ত করেছে। বিশ্বব্যাংকে গেলে তিন বছরেও এসব কাজ করা যেত না। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতা ও কমিটমেন্ট কাজ দিয়েছে। তিনি বলেছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যা করতে হবে তাই করব।
সমকাল :ভাড়া বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে আর্থিকভাবে সংকটে পড়েছে পিডিবি। এই সমালোচনার জবাব কী?
ড. তৌফিক-ই-ইলাহী :বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে যারা কথা বলছেন, তাদের কোনো কাজ নেই। আমাদের তো কাজ আছে। তাই টক শোতে যেতে পারি না। সেখানে গেলে কাজ করতে পারব না। আমরা যখন পরিকল্পনা করি তখন অনেকে এর সমালোচনা করে। কিন্তু কেউ পরিকল্পনা দেয় না। টক শোতেও সমাধানের উপায় বলা হয় না। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কেউ কেউ সমালোচনা করে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশের পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় এখানে দুই টাকা কমে বিদ্যুৎ বিক্রি হচ্ছে। সম্প্রতি বিদ্যুতের যে দাম বেড়েছে তা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে।
সমকাল :জ্বালানি তেলনির্ভর কেন্দ্রের দিকে বেশি ঝুঁকলেন কেন?
ড. তৌফিক-ই-ইলাহী :আমাদের গ্যাসের সমস্যার কারণে বাধ্য হয়ে বিকল্প চিন্তা করতে হয়েছে। বিশেষ করে জ্বালানি তেলনির্ভর কেন্দ্রে যেতে হয়েছে। তবে যেখানে ভবিষ্যতে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে আমরা ডুয়েল ফুয়েল কেন্দ্র করেছি। এ ছাড়া পুরনো কেন্দ্রের পরিবর্তে সাশ্রয়ী গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
সমকাল :বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে দেশের কী লাভ হয়েছে?
ড. তৌফিক-ই-ইলাহী :বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে সরকারকে বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, এটা ঠিক। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির সুফলও কিন্তু এখন সব ক্ষেত্রে পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা ইতিবাচক দিকগুলো দেখতে পারছেন না। বিশ্বের বিকাশমান পরিস্থিতিতে সবকিছুতে ভারসাম্য থাকবে না। ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করতে হবে। সমস্যা এলে তা চ্যালেঞ্জ নিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। বিদ্যুৎ সংকটে উন্নয়ন শুরু হওয়ায় এ দেশে আবারও বিদেশি উদ্যোক্তা আসতে শুরু করেছে। বিশেষ করে চীনসহ অনেক দেশের উদ্যোক্তা এ দেশের গার্মেন্ট খাতে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে। আগামীতে ঢাকা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম 'গার্মেন্ট হাব' হবে। কিন্তু এ দেশের সমালোচকরা 'বেশি জ্ঞানী' বলে তারা এসব দেখছেন না।
সমকাল :কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করলেন না কেন?
ড. তৌফিক-ই-ইলাহী :কারণ এ মুহূর্তে যদি কয়লার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলেও তা উত্তোলনে কমপক্ষে সাত বছর সময় লাগবে। এ সময় পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা তো আমার জন্য বসে থাকবে না। ফলে স্বল্পমেয়াদে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের কথা চিন্তা করা হয়নি। এখন আমদানি করা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সমকাল : কয়লানীতি এখনও চূড়ান্ত হচ্ছে না কেন?
ড. তৌফিক-ই-ইলাহী : কয়লা নিয়ে সরকার ধীরে এগোচ্ছে। ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টিও মাথায় রাখা হয়েছে। কয়লা খনিগুলো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়। ওখানে মাটির নিচে প্রচুর পানি। ভালোভাবে আবার জরিপ কাজ করতে হবে। সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আগে বিশষজ্ঞরা কয়লা নিয়ে কয়েকটি কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে। কিন্তু এগুলো রচনা। সেখানে সকলের ভালো মতগুলো সনি্নবেশিত হয়েছে, যা কোনোভাবেই বাস্তবানুগ নয়।
সমকাল : বিশেষ আইন করার জন্য পরবর্তীকালে মামলার আশঙ্কা করেন কি-না?
ড. তৌফিক-ই-ইলাহী : দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিশেষ আইন করতে ব্যবসায়ীদেরও দাবি ছিল। এ কারণে বিশেষ আইন সংসদ পাস করেছে। তাই অন্য কোনো সরকার ভবিষ্যতে সরকার গঠন করলে সেটি বাতিল করতে পারে। তাই বলে মামলা করা যায় না। কারণ আইনের মাধ্যমে লিগ্যাল একটি ফ্রেমওয়ার্ক দেওয়া হয়েছে। এরপরও যদি জেলে যেতে হয় তবে সে জন্য প্রস্তুত আছি। জেল খাটার অভিজ্ঞতা আছে।
সমকাল : অনভিজ্ঞদের কাজ দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে কী বলবেন?
ড. তৌফিক-ই-ইলাহী :এ দেশের অনভিজ্ঞ উদ্যোক্তারা বিদেশি অথবা এ দেশীয় দক্ষদের সঙ্গে কাজ করে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছে। এতে দেশের লাভ হয়েছে, অগ্রগতি হয়েছে।
সমকাল : বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য তেল আমদানির ক্ষেত্রে কি সমস্যা হচ্ছে?
ড. তৌফিক-ই-ইলাহী :তেল আমদানি, জাহাজ থেকে খালাস, সেখান থেকে ডিপোতে নেওয়া এবং ওই তেল বিদ্যুৎকেন্দ্রে পেঁৗছানো এবং মজুদ সব ক্ষেত্রেই সমস্যা হচ্ছে। জানুয়ারিতে কৃষি সেচ মৌসুম শুরু হলে সমস্যা আরও প্রকট হতে পারে। কারণ তখন বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি সেচের জন্যও অধিক হারে তেল লাগবে। নৌপথ ড্রেজিং, রেলওয়ের সরবরাহ সুবিধা বাড়াতে হবে। এটা একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এটা আমরা পুরোপুরি অবগত। এ জন্য বড় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের সরাসরি তেল আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
সমকাল : সাশ্রয়ী বাতি সরবরাহে দুর্নীতির অভিযোগ স্বীকার করেন কি-না?
ড. তৌফিক-ই-ইলাহী :বিনা মূল্যে সাশ্রয়ী বাতি দেওয়ার উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ ছিল। কিন্তু এই বাতির ক্ষেত্রে অনিয়ম বা চুরি হয়ে থাকতে পারে। এ জন্য অনেক বাতি নষ্ট হয়েছে। তাই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ৩০ শতাংশ বাতি বদলে দিতে বলা হয়েছে। তারা ১০ শতাংশ বাতি বদলে দিতে চেয়েছে।
সমকাল : গ্যাস খাতের ঘাটতি কাটছে না কেন?
ড. তৌফিক-ই-ইলাহী :গ্যাস খাতে দীর্ঘদিন কাজ না হওয়ায় এ খাতের উন্নয়ন প্রথম দিকে দৃশ্যমান হয়নি। তবে এখন তা দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে দৈনিক প্রায় ৩৫ কোটি ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বেড়েছে। আরও উৎপাদন বৃদ্ধি করতে এখন নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থা গ্যাসপ্রম ১০টি কূপ খনন করবে। সরবরাহজনিত সীমাবদ্ধতার কারণেও সিলেট অঞ্চল থেকে বাড়তি গ্যাস গ্রিডে আনা যাচ্ছে না। এ জন্য এখন বড় বড় সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
সমকাল : শিল্পে গ্যাসের সমস্যা দূর হবে কবে?
ড. তৌফিক-ই-ইলাহী :গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে। নতুন গ্যাস অনুসন্ধানের পাশাপাশি পুরনো ক্ষেত্রে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। সংকট মোকাবেলায় আগামীতে শিল্প কারখানায় ক্যাপটিভ পাওয়ার কেন্দ্রে (নিজস্ব বিদ্যুৎ জেনারেটর) আর গ্যাস সংযোগ দেওয়া হবে না। শিল্প কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে। তাদের বেশি দামে আলাদা লাইনে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়া হবে। গ্যাসের ওপর চাপ কমাতে সরকার এ উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে কারখানার বয়লার চালানোর জন্য গ্যাস দেওয়া হবে।
সমকাল : আবাসন খাতে সংযোগ দেবেন কি-না?
ড. তৌফিক-ই-ইলাহী :আগামীতে আবাসিক সংযোগে গ্যাস দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত নেই।
সমকাল : ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি আর কতদূর?
ড. তৌফিক-ই-ইলাহী :ভারত থেকে সরকারি উদ্যোগে আড়াইশ' মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে। এ বিষয়ে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, তা প্রায় কেটে গেছে। এ বিষয়ে প্রস্তুতিও প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও ভারত থেকে আরও আড়াইশ' মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনা হবে।
এ ছাড়া ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে ভারত ইতিমধ্যে সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছে। নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়েও কথা হয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সফরে গিয়ে সে দেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ব্যাপারে কথা বলেছে। ভারতের আসাম, মিজোরাম, ত্রিপুরার মতো রাজ্যগুলোতে যৌথ উদ্যোগে জলবিদ্যুৎ স্থাপনের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলোর সঙ্গে শিগগিরই আলোচনা শুরু হবে।
সমকাল : বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ কতদূর এগিয়েছে?
ড. তৌফিক-ই-ইলাহী : গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি করতে বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সংকট মোকাবেলায় সরকার ২০১২ সালের মধ্যে এলএনজি (তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিষয়ে সমীক্ষার জন্য সম্প্রতি পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে। সমীক্ষা শেষে দরপত্র আহ্বান করে মহেশখালীতে ভাসমান মজুদাগার ও গ্যাসে পুনঃরূপান্তর ইউনিট স্থাপন এবং প্রয়োজনীয় পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে গ্যাস আমদানির লক্ষ্যে নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.