উৎসব-প্রণয় ও দায়িত্বের দ্বন্দ্ব by আশীষ-উর-রহমান

দেহ আজ্ঞা দেবযানী, দেবলোকে দাস করিবে প্রয়াণ’ বলে কচ এসে করজোড়ে দাঁড়িয়েছেন দেবযানীর সামনে। সহস্র বর্ষের সাধনা সমাপ্ত তাঁর। রাক্ষসদের গুরু শুক্রাচার্যের গৃহে বাস করে লাভ করেছেন তিনি মহার্ঘ সঞ্জীবনীবিদ্যা। দেবগুরু বৃহস্পতিপুত্র কচ এবার ফিরে যাবেন স্বর্গে। সঞ্জীবনীবিদ্যা দান করবেন দেবকুলে। যাওয়ার আগে তিনি বিদায় নিতে এসেছেন গুরু শুক্রাচার্যকন্যা দেবযানীর কাছে। কন্যা বিস্মিত, ব্যথিত, হাজার বছর একসঙ্গে অবস্থান করে মাত্র এই দুই


কথায় বিদায়! ‘বিদায় অভিশাপ’ কবিতাটি কবিগুরু শুরু করেছিলেন এভাবেই। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় নাট্যরসগুণসম্পন্ন এই কবিতাটি নৃত্যের সঙ্গে ফুটিয়ে তুললেন নৃত্যশিল্পী তামান্না রহমান ও তাঁর সঙ্গীরা। সুরের ধারা আয়োজিত রবীন্দ্র-উৎসবের দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের মিল্কিওয়েতে তুষারশুভ্র মঞ্চে পরিবেশিত হলো ‘বিদায় অভিশাপ’ অবলম্বনে নৃত্যনাট্য। গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া তিন দিনের রবীন্দ্র-উৎসব শেষ হবে আজ শনিবার। উৎসবের সহায়তা করেছে প্রথম আলো ও চ্যানেল আই।
নেপথ্যে দ্বৈত কণ্ঠের আবৃত্তি। মঞ্চে নৃত্যছন্দে তার রূপায়ণ। মহাভারতে কচ-দেবযানী উপাখ্যান অবলম্বন করে ‘বিদায় অভিশাপ’ কবিতাটি কবি রচনা করেছিলেন বাংলাদেশেই, নওগাঁর পতিসরে। দেবতা-রাক্ষসের যুদ্ধ। দেবতারা রাক্ষসদের সঙ্গে পেরে উঠছেন না। কারণ, রাক্ষসদের গুরু শুক্রাচার্য সঞ্জীবনীবিদ্যায় যুদ্ধে নিহত রাক্ষসদের পুনর্জীবন দান করেছেন। তাই দেবতাদের গুরু বৃহস্পতি তাঁর তরুণ পুত্র কচকে পাঠালেন মর্ত্যে। যে করেই হোক শুক্রাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সঞ্জীবনীবিদ্যা আয়ত্ত করতে। ব্রাহ্মণের বেশে কিশোর কচ এল এক প্রভাতে মর্ত্যের তপোবনে। শুক্রাচার্যের কিশোরীকন্যা তখন পুষ্পচয়নে রত। কচ এসে তাকে বলল, ‘ফুল তুলে দেব, দেবী।’ এভাবে দুজনের পরিচয়।
তারপর তো পেরিয়ে গেল বেণুমতী নদীর তীরে, গুরুর কুটিরে দীর্ঘ সহস্র বছর। গুরুর মন জয় করে কচ লাভ করেছেন পরম আরাধ্য সঞ্জীবনীবিদ্যা। বিপত্তি ঘটে গেল দেবযানীর কাছে বিদায় নিতে এসেই। দেবযানী অনুরোধ করলেন কচকে মর্ত্যে থেকে যেতে। দুজনে মিলে মাটির ধরণিতেই স্বর্গলোক রচনা করবেন বেণুমতীর তীরে। তাঁর উক্তি বিখ্যাত ‘বিদ্যাই শুধু অমূল্য তবে, প্রেম কি হেথা এতই সুলভ...নারীর হূদয় সখা সহস্র বর্ষেই সাধনার ধন’। কিন্তু কচ তাঁর প্রতিজ্ঞায় অটল। দায়িত্ব পালনে আত্মস্বার্থত্যাগে দৃঢ়সংকল্প। স্বর্গ যদি আর স্বর্গ বলে না-ও মনে হয়, হূদয়ে যদি চিরতৃষ্ণা জেগে থাকে, দগ্ধ হয় অন্তর, তবু তিনি যাবেনই যাবেন—সেই সুখহীন স্বর্গধামে।
কর্তব্যপরায়ণতা এবং মানব-মানবীর চিরন্তন হূদয়ানুভূতির আবেদন—এই দুয়ের দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে কালজয়ী আখ্যান সৃষ্টি করেছেন, তার চমৎকার নৃত্য রূপায়ণ মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের।
দেবযানীর ভূমিকায় ছিলেন তামান্না রহমান ও কচের ভূমিকায় সুব্রত দাস। কিশোর কচ-দেবযানীর ভূমিকায় হায়দার আলী ও মননী অর্থী। কবিতা আবৃত্তি করেছেন মাহিদুল ইসলাম ও শ্যামলী সুলতানা।
এর আগে গতকাল বিকেলে একক কণ্ঠের সংগীত পরিবেশনায় লিলি ইসলাম গেয়ে শোনান ‘আজি কোন সুরে বাঁধিব’, ফাহিম হোসেন চৌধুরী গেয়েছেন, ‘অলি বারবার ফিরে যায়’, লাইসা ইসলামের কণ্ঠে ছিল ‘বড় বেদনার মতো’, মহাদেব ঘোষ শুনিয়েছেন ‘নহ মাতা নহ কন্যা’। এর আগে ছিল এমদাদ হকের পোশাক, কানিজ আলমাস খানের সজ্জা ও মিনু হকের কোরিওগ্রাফিতে রবীন্দ্রনাটক ও উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের রূপায়ণে ফ্যাশন শো। ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় আবৃত্তি করেন শেষের কবিতা উপন্যাসে লাবণ্যের লেখা শেষ কবিতা, ‘কালের যাত্রাধ্বনি শুনিতে কি পাও...তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান, গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়...হে বন্ধু বিদায়’।
বিকেল থেকেই গতকাল ছুটির দিনে বিপুল দর্শক সমাগম ঘটেছিল রবীন্দ্র-উৎসবে। সারা দিন ছিল সেমিনার, গান, আবৃত্তি, নৃত্য—সব মিলিয়ে বৈচিত্র্যময় পরিবেশনা। অনুষ্ঠান উপভোগের পাশাপাশি মিল্কিওয়েতে আয়োজিত মেলার অডিও স্টল থেকে রবীন্দ্রনাথের গানের অ্যালবাম, প্রথমা প্রকাশনীর স্টল থেকে পছন্দের বইসহ টুকিটাকি কেনাকাটাও করেছেন অনেকে।
সন্ধ্যার পর হল অব ফেইমে ছিল সুরের ধারার পরিবেশনায় গীতিনাট্য কালমৃগয়া। মিল্কিওয়েতে একক ও দলীয় সংগীত। দিনের আয়োজন সাঙ্গ হয়েছিল এক অনবদ্য ব্যতিক্রমী পরিবেশনা দিয়ে। বিশ্বের ১৭টি দেশের শিল্পীদের সমন্বয়ে গড়া গান্ধর্বলোক অর্কেস্ট্রা পাশ্চাত্যের যন্ত্রানুষঙ্গে পরিবেশন করে রবীন্দ্রনাথের গান। সেই গানের রেশ নিয়ে প্রাণে ঘরে ফিরেছিলেন শ্রোতারা।

No comments

Powered by Blogger.