ঢাকার খাল ফের দখল by রাজীব আহাম্মদ ও সোহেল মামুন

বৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে রাজধানীর খালগুলো দখলমুক্ত করার কিছুদিনের মধ্যেই আবার দখল হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, উচ্ছেদের পর বছরের পর বছর মনিটরিং করা হবে না_ এমন নিশ্চয়তা পেয়েই ফের স্থাপনা নির্মাণ শুরু করে দখলদাররা। উচ্ছেদ অভিযানে একদিনেই ওয়াসার ব্যয় হয় লাখ টাকার বেশি। সেই হিসাবে বছরে আধা কোটি টাকা খরচ হয় কেবল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে। ঢাকা ওয়াসার সর্বশেষ খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত


তিন বছর সময়ে ১০টি খালের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। যার মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২২ কিলোমিটার। এর মধ্যে এ বছরই উদ্ধার করা হয়েছে ৬টি খাল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খালগুলো দখলমুক্ত রাখতে ওয়াসার মনিটরিং টিম গঠন করা দরকার। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, যারা ফের
খাল দখল শুরু করেছেন, তারা ভুল করছেন। শিগগিরই ওয়াসা খাল উন্নয়ন শুরু করবে।
রাজধানীর কল্যাণপুরে 'ঘ' খাল সরেজমিনে দেখা যায়, খালের জমি দখল করায় কয়েক মাস আগে বাড়ির আংশিক ভাঙ্গা হয়েছিল। সেই ভাঙ্গা অংশে এরই মধ্যে ইটের গাঁথুনি দিয়ে নতুন দেয়াল তোলা হয়েছে। অবশ্য পলেস্তারা করা হয়নি। রাজধানীর দক্ষিণ পীরেরবাগে 'ঘ' খালের পাশে তিনতলা বাড়িটির হোল্ডিং নম্বর ১৪৯/২। বাড়ির একজন ভাড়াটিয়া বললেন, তিনি জানতে পেরেছেন ফের ভেঙে ফেলা হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই পলেস্তারা করা হয়নি। বাড়ির ম্যানেজার অবশ্য বলেছেন, খালের ৬ ফুট ছেড়ে এবার দেয়াল তোলা হয়েছে। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে বাড়িটির ১২ ফুট অংশ খালের জমিতে পড়েছিল। কল্যাণপুরের এই খালটি ধরে উত্তর দিকে এগোলে চোখে পড়বে আরও দুটি বাড়ির নির্মাণকাজ। খালের জমি দখল করে বাড়ি করায় এ বাড়ি দুটিরও আংশিক ভেঙে দেয় ওয়াসা। সেই অংশে ফের বাড়ি নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে।
২০০৭ সালের পর চলতি বছরের (২০১১) ১২ থেকে ১৬ আগস্ট দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘের কল্যাণপুর 'ঘ' খালে উচ্ছেদ অভিযান চালায় ঢাকা ওয়াসা। এ বছর উচ্ছেদ করা হয় শতাধিক স্থাপনা। শুধু কল্যণপুর 'ঘ' খাল নয়, চলতি বছর দখলমুক্ত করা খালগুলো সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সব খালেই নতুন করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। মোহাম্মদপুরের কাটাসুর খাল, আবদুল্লাহপুর খাল, খিলগাঁও বাসাবো খাল, শাহাজাদপুর খাল, সূতিভোলা খাল, সেগুনবাগিচা খাল, ইব্রাহিমপুর খাল, বাউনিয়া খাল, ডেমরা খাল, কল্যাণপুর প্রধান খাল, মিরপুর হাউজিং খাল, মাণ্ডা খাল, কসাইবাড়ি খালের বিভিন্ন অংশ ভরাট হয়ে গেছে।
বৃহস্পতিবার মহাখালী, কল্যাণপুর ও রূপনগর খাল ঘুরে দেখা গেছে অবৈধভাবে খাল পুনর্দখলের নানা চিত্র। মহাখালী খালের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ২২ কিলোমিটার। নাখালপাড়া থেকে গুলশান-নিকেতনের দিকে প্রবাহিত হয়েছে খালটি। মহাখালী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন প্রধান সড়কের পশ্চিম অংশে খালের জমিতে চলছে রাস্তা নির্মাণ। মহাখালী খালের ওই অংশে রয়েছে বক্স কালভার্ট। আর এ কালভার্টের ওপর দিয়ে খালের আশপাশের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রাস্তা নির্মাণের প্রস্তুতি নিয়েছেন। নির্মাণ কাজের ঠিকাদার স্বপন জানান, স্থানীয় বাসিন্দাদের সুবিধার জন্য ওয়াসার অনুমতি নিয়েই সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। অথচ এ বিষয়ে একেবারেই অন্ধকারে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান সমকালকে বলেন, 'মহাখালী খালের বক্স কালভার্ট দিয়ে রাস্তা নির্মাণের কোনো প্রশ্নই আসে না। ওই বক্স কালভার্ট ভেঙে ফেলার চিন্তাভাবনা চলছে।'
কল্যাণপুর 'ক' ও 'খ' খাল ভরাট করে অনেক আগেই স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল। 'ক' খালে বহুতল ভবন গড়ে ওঠায় মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় এ খালটির অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে যায়নি ওয়াসা। 'ক' খালের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যও নেই ওয়াসার কাছে। ২ দশমিক ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘের 'খ' খালটি মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলার পর অবশ্য অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। বৃহস্পতিবার মরে যাওয়া খালটি ঘুরে দেখা গেছে, উচ্ছেদ করা অংশে ফের গড়ে উঠেছে রিকশার গ্যারেজ। কয়েকটি বস্তিঘর। রয়েছে মুরগির খামার। খালের চিহ্নিত জমি দিয়ে পশ্চিম দিকে এগুলেই 'ঢাকা ওয়াসার জরুরি বিজ্ঞপ্তি' লেখা সাইনবোর্ড চোখে পড়বে। এই সাইনবোর্ডের বিজ্ঞপ্তির বিস্তারিত লেখা মুছে ফেলা হয়েছে। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ জানায়, বিজ্ঞপ্তিতে লেখা ছিল 'ঢাকা ওয়াসার কল্যাণপুর স্টর্ম ওয়াটার পাম্পিং স্টেশন সংলগ্ন রেগুলেটিং পন্ড সংরক্ষণ প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমি'।
মিরপুরে ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ ও তিন থেকে ১৮ মিটার প্রস্থের রূপনগর খালে মাটি ফেলে পানিপ্রবাহ বিঘি্নত করছে খোদ সরকারি দুই সংস্থা রাজউক ও বিসিআইসি। খালের জমির পশ্চিম অংশে ভরাট করে হাউজিং করেছে রাজউক। তার পাশেই বিসিআইসির সাইনবোর্ড লাগানো জমি। সংস্থাটির দখলেও গেছে খালের জমি। বেসরকারি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ইস্টার্ন হাউজিং খাল ভরাট করায় পানিপ্রবাহে বিঘ্ন ঘটছে।
খাল উদ্ধারের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা ওয়াসার দু'জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াছিউদ্দিন ও নাসির উদ্দিন। ফের দখল প্রসঙ্গে ওয়াছিউদ্দিন বলেন, দখলমুক্ত করাই আমাদের দায়িত্ব। এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ওয়াসার। ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, যে খালগুলো দখলমুক্ত করা হয়েছে সেগুলোতে যেন আর অভিযান চালাতে না হয় সেজন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। উদ্ধার করা খালগুলোর পাশ দিয়ে ওয়াকওয়ে (হাঁটার পথ) নির্মাণ করা হবে। ইতিমধ্যে রামচন্দ্রপুর খালে নির্মাণকাজ শুরু করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.