স্মরণ-কমরেড মণি সিংহ : শেকড়ে ফিরে যাওয়া

মাদের দেশের স্বাধীনতার পর পরই সুসং দুর্গাপুরে মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাই ১৯৭২ সালের একদম শুরুর সময়। আগেই বাবার কাছে জেনেছিলাম, টঙ্ক আন্দোলনের পর আমাদের বাড়িঘর ট্রাক্টর দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। যদিও বাড়িটা যৌথ সম্পত্তি ছিল, তার পরও পাকিস্তানের নুরুল আমীন সরকার আমার মেজ জ্যাঠিমা এবং জ্যাঠাত দুই বোনকে বস্তুত বাড়ি থেকে বের করে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছিল। টঙ্ক আন্দোলন দমানোর জন্য এ ধরনের বর্বর অত্যাচার করা


হয়েছিল তখন মণি সিংহের পরিবারের সদস্যদের ওপর। সুসং দুর্গাপুরে আমাদের যেখানে আগে বাড়ি ছিল (সিংহ বাড়ি, বাগিচাপাড়া), বাবার কাছে গল্প শুনেছি বেশ বড় জায়গা নিয়ে ছিল আমাদের বাড়িটা, ওই বাড়ির সামনের দিকে বাবা একটি বৈঠকখানা বানিয়েছিলেন টঙ্ক আন্দোলনের সময়। ছোটবেলায় এসব গল্প শুনে সুসং দুর্গাপুর দেখার এবং কোথায় ছিল আমাদের বাড়ি এসব বিষয়ে আমার যথেষ্ট কৌতূহল ছিল। নিজেদের বাড়ি না থাকায় সে সময় আমরা সুসং দুর্গাপুরে প্রয়াত অ্যাডভোকেট নগেন্দ্র শেখর রায়ের বাসায় উঠেছিলাম। যা হোক, যেদিন আমরা সুসং দুর্গাপুর পেঁৗছাই তার পরদিন সকালে দেখি বেশ কিছু লোক, ৮-১০ জন বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য বৈঠকখানায় বসে আছেন। বাবা তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন। মনে আছে, তাঁরা সবাই বাবার কাছে 'আশীর্বাদ' চাইছিলেন। বাবাও তাঁদের আশীর্বাদ করেছিলেন। পুরো ঘটনা দেখে আমি খুবই অবাক হচ্ছিলাম। আরেকটি ঘটনা আমার মনে বাবা সম্পর্কে গভীর ছাপ রেখেছিল। এখন পর্যন্ত সুসং দুর্গাপুর বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল। আমার বিবেচনায় আজ থেকে ৬০ বছর আগে পরিস্থিতিটা আরো নাজুক ছিল। যদিও ঝারিয়া-ঝাঞ্ঝাইল পর্যন্ত রেললাইন ব্রিটিশ আমলেই পাতা হয়েছিল। সুসং দুর্গাপুরের জমিদারদের ব্রিটিশরা 'মহারাজা' খেতাব দিয়েছিলেন। জমিদারদের তিন তরফ ছিল। বড় তরফের জমিদাররা বাবার সম্পর্কে মামা ছিলেন। আমার ঠাকুরদা কালী কুমার সিংহ অকালে মারা যাওয়ায় জমিদাররা আমার ঠাকুরমাকে (সরলা দেবী) অনেক জমি দান করেছিলেন। সুসং দুর্গাপুরের মহারাজরা সাধারণ কৃষকদের অত্যাচার করতেন। যেহেতু জমির ওপর মহারাজাদের অধিকার ছিল অবিসংবাদিত। তাই ফসল হোক আর না হোক কৃষককে ধান খাজনা হিসেবে দিতে হতো। এভাবে লাখ লাখ মণ ধান জমিদারের গোলায় জমা হতো। এর নাম ছিল টঙ্ক প্রথা। তখন আমাদের পরিবারের অনেক টঙ্ক জমি ছিল এবং এটাই ছিল আমাদের আয়ের অন্যতম উপায়। ১৯২৮ সাল থেকে বাবা কলকাতায় মাটিয়াবুুরুজে শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত। শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করার কারণে ১৯৩০ সালে তাঁর জেল হয়ে যায়। ১৯৩৬ সালে তাঁকে খালাস দিয়ে দুর্গাপুরে নিজের বাড়িতে অন্তরীণ করা হয়। অর্থাৎ সুসং দুর্গাপুর থানায় তাঁকে নিয়মিত হাজিরা দিতে হতো যে তিনি এখানেই আছেন। কলকাতায় যাওয়া দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বাবা যখন বাড়িতে ফিরে এলেন এ সময় একদিন এলাকার কৃষকরা তাঁর কাছে অত্যাচারী টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে কিছু করার জন্য উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। আমাদের নিজেদের টঙ্ক জমি ছিল এবং জমিদাররা বাবার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন। ওই সময় (১৯৩৬) সুসং দুর্গাপুরে কমিউনিস্ট রাজনীতি করতেন এমন কোনো লোক ছিল না যার সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করা সম্ভব। বাবার জন্য এটা ছিল কঠিন ও জটিল বিষয়। এ তো নিজের বিরুদ্ধে ও নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। বাবার সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। নিজ এলাকায় অন্তরীণ অবস্থা শেষ হওয়ার পর কলকাতায় ফিরে গিয়ে শ্রমিক আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করা। এতে কোনো ঝামেলা থাকছে না। একজন কমিউনিস্ট হিসেবে, একজন জননেতা হিসেবে আদর্শ ও জনগণের স্বার্থের মিল ঘটিয়ে সঠিক অবস্থান নিয়েছিলেন। এ রকম ত্যাগী ও আদর্শবাদী হওয়া কতজনের পক্ষে সম্ভব তা আমার জানা নেই। বাবার দীর্ঘ আত্মগোপন ও জেলে থাকার কারণে কখনোই খুব বেশি সময় একনাগাড়ে একসঙ্গে থাকার সুযোগ ছিল না। তবে ছোটবেলা থেকেই মায়ের কাছে শুনে শুনে বাবা সম্পর্কে, রাজনীতি বিষয়ে, সমাজতান্ত্রিক সমাজ সম্পর্কে, মানুষের মুক্তির জন্য আমার মনে গভীর আকর্ষণ ও আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল। ডা. দিবালোক সিংহ

No comments

Powered by Blogger.