সদরে অন্দরে-শাবাশ আগামীর নাগরিকরা by মোস্তফা হোসেইন

মুখ রেখেছে সোনামণিরা। খুব ভালো ফল করেছে ওরা। এমন সুন্দর এবং আশাজাগানিয়া ফল করবে তারা_এটাই তো প্রত্যাশা আমাদের। বলছি, যারা জেএসসি এবং জেডিসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের। অভিনন্দন তাদের সবাইকে।
রেকর্ডসংখ্যক শিক্ষার্থী এবার উত্তীর্ণ হয়েছে জেএসসি পরীক্ষায়। পাসের হার এবং ভালো ফল করার ক্ষেত্রেও রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সংগত কারণেই খুশি হওয়ার কথা ফল প্রকাশের পর। কিন্তু তার পরও কিছু বিষয় আছে, যা আমাদের দীনতাকে


আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আমাদের স্বীকার করতে বাধ্য করে যে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নয়নের জন্য আরো অনেক কিছু করার আছে। ধরা যাক ভালো রেজাল্টের কথা। মেধাবীদের কথা। গ্রাম এবং শহর_এভাবে বিভাজন হতে পারে এই দিকটি। প্রভেদটা অনেক বেশি গ্রামে আর শহরে। এখনো গ্রাম পিছিয়ে আছে ফলাফলের দিক থেকে। যেহেতু সারা দেশেই পাসের হার বেড়েছে, তাই সেই বৃদ্ধির ছোঁয়া গ্রামের স্কুলগুলোতেও লেগেছে। কিন্তু ভালো ফলের অসমতা আমাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। এ ক্ষেত্রে গ্রামের অবস্থান পরিবর্তন হয়নি মোটেও। আটটি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের ফল বিশ্লেষণ করে যে চিত্র পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, গ্রামের উন্নতি হয়নি বললেই চলে। প্রতি বোর্ডের মধ্যে সেরা ২০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা করতে গিয়ে দেখা গেছে, ১৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ২০টি সেরা স্কুল গ্রাম কিংবা উপজেলা শহরে অবস্থিত। বাকিগুলো সবই জেলা, বিভাগীয় শহর কিংবা রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত। আবার সরকারি ক্যাডেট কলেজগুলো আগের মতো একচেটিয়া প্রাধান্য ধরে না রাখতে পারলেও তারা এগিয়ে আছে অনেক।
ভালো ফল করার ক্ষেত্রে শহরমুখী এই প্রবণতা আমাদের সামাজিক বৈষম্যকেই ফুটিয়ে তোলে। আমাদের বলে দেয়, সমাজ এখনো এই দুই বিভাজনকে টিকিয়ে রেখেছে কঠিন বাস্তবতা হিসেবে। এ প্রসঙ্গে একাধিক গ্রামের স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা হয়েছে এই লেখকের। গ্রামের স্কুলগুলো তুলনামূলকভাবে শহরের তুলনায় কম ভালো ফল করেছে। এর পেছনে কী কী কারণ রয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে কুমিল্লা জেলার সিদলাই আশরাফ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক গোলাম মোস্তফা বলেছেন মূলত অর্থনৈতিক বিষয়টির কথা। দক্ষ শিক্ষকদের গ্রামবিমুখ হওয়া, সচেতন অভিভাবকের অভাব, শিক্ষার পরিবেশ না থাকা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে নামিদামি স্কুলে ভর্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষাও গ্রামের স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের মেধা তালিকায় স্থান না পাওয়ার মূল কারণ বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। দক্ষ শিক্ষকের অভাবের কথা জানাতে গিয়ে তিনি নিজের স্কুলের একটি উদাহরণ দেন। তাঁর স্কুলে কম্পিউটার বিজ্ঞানের শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিলে দক্ষিণবঙ্গে বাড়ি এমন একজন মাত্র প্রার্থীর দরখাস্ত পেয়েছেন। সে প্রার্থীর আবার গ্রামে গিয়ে চাকরি করার মানসিকতা আছে কি না তা সন্দেহজনক।
গ্রামের চিরন্তন পরিবেশেও পরিবর্তন এসেছে, যা সেখানকার শিক্ষার্থীদের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক পরিবর্তনের বিষয়টি উল্লেখ করার মতো। আকাশ সংস্কৃতির ছোঁয়া লেগেছে গ্রামে গ্রামে। উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি শহরে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করতে পারে না গ্রামের শিক্ষার্থীদের মতো। এখানেও গ্রামের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের অসচেতনতা দায়ী বলে মনে করা যায়। এ ক্ষেত্রে একটি ভালো কলেজের অধ্যক্ষের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলা যায়। শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সেরা দশে স্থান করে নিতে সক্ষম এমন একটি কলেজের সেই অধ্যক্ষ প্রায়ই শহর থেকে গ্রামে চলে আসেন নিজের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া তদারক করার জন্য। এমনি এক রাতে তিনি এক ছাত্রের বাড়িতে গিয়ে দেখেন, শিক্ষার্থী পাশেই ওয়াজ মাহফিলে ওয়াজ শুনতে গেছে বিকেলবেলা। আর রাত ৯টায়ও সে ফেরেনি। অভিভাবকদের মনোভাবও এমন যে ছেলে গেছে পুণ্যকাজে, তাতে ক্ষতির কী আছে। অথচ সপ্তাহকাল পরেই তার পরীক্ষা। এমনি অভিজ্ঞতার কথা আরেকটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকও বর্ণনা করেছেন এই লেখকের কাছে। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী রাত ৯টার সময় এক বাড়িতে গিয়ে দেখেন, তাঁর ছাত্রীটি লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। আর পাশে বসে বসে তার মা-বাবা টেলিভিশন দেখছেন।
গ্রাম আর শহরের মধ্যে এই পরিবেশগত দিকের পার্থক্য আছে ব্যাপক। শহরের একজন মা কখনো পরীক্ষার্থী সন্তানের পড়ালেখা বাদ দিয়ে টেলিভিশন প্রোগ্রাম দেখবেন না। কিংবা রাত ৯টায় তাঁর সন্তানকে লেখাপড়া বাদ দিয়ে লেপের নিচে পাঠাবেন না। এ কারণে গ্রামের একজন শিক্ষার্থীর ভালো ফল অর্জনটা লেপের নিচের মতো অন্ধকারে থাকে। আর শহরের শিক্ষার্থীটি ঠিকই কার্যকর করে ফেলে।
লক্ষ্মীপুর জেলার দালালবাজার হাই স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক খন্দকার মোহসেন নিজের স্কুলের পাসের হারের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, ৯৯ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হলেও সেখানে জিপিএ ফাইভ পায়নি একজনও। শতকরা হার বাড়ার পেছনে তিনি মনে করেন, ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে শিক্ষার্থীদের প্রতি অধিক নজর দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। একজন শিক্ষার্থী এক বিষয়ে পরীক্ষা দিতে না পারার কারণে তাদের স্কুলটি শতভাগ পাসের তালিকায় স্থান করে নিতে পারেনি।
গ্রামের স্কুলগুলোতে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ঘাটতি থাকে। আর এটা কিন্তু প্রাথমিক স্তরের কারণেও হয়ে থাকে। সাধারণত গ্রামের শিক্ষার্থীদের প্রাথমিককাল কাটে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেগুলোর শিক্ষার মান থাকে নিম্ন। যে কারণে হাই স্কুলে যে শিক্ষার্থীটি আসে তার ভিত্তি থাকে দুর্বল। তখন থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে প্রধান লক্ষ্য থাকে, অধিক হারে শিক্ষার্থীকে পাস করিয়ে আনতে হবে। আগে এই আকাঙ্ক্ষা তাদের পূরণ হতো খুবই কম। হালে অগ্রগতি হয়েছে বেশ। তারা তাদের শিক্ষার্থীদের বেশি হারে পাস করিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এই অর্জন আরো শক্তিশালী হবে উত্তীর্ণদের মেধা বিকাশের মাধ্যমে। সুতরাং যেভাবে শিক্ষার্থীরা পাসের হার বাড়িয়ে নিজেদের ভাগ্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে, তেমনি তারা একসময় মেধাবী হিসেবেও নিজেদের প্রমাণ করতে পারবে। তো সেই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আজকে শিক্ষকদের আর ছাত্র বেতনের ওপর নির্ভর করতে হয় না। সরকার তাঁদের বেতনের মূল পুরোটাই প্রদান করছে। বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক হওয়ার পরও এমন সুবিধা যেখানে পাচ্ছেন তাঁরা, সেখানে তাঁদেরও জাতিকে কিছু দেওয়ার আছে। আমরা প্রত্যাশা করি, শিক্ষকরা জাতির কাছ থেকে যা পাচ্ছেন তার বিনিময়ে নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার মাধ্যমে তা শোধ করবেন। তাঁরা ইচ্ছা করলে সোনামণিরা আরো ভালো ফল করতে পারবে। তাঁরা যদি আন্তরিক হন, তাহলে আজকে যেমন সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থী ছিটকে পড়েছে, সেই সংখ্যা আরো কমে যাবে। আমাদের শিক্ষা খাতে অপচয় কমে যেতে পারে।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.