শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা by শতদল বড়ূয়া

জ শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন। ভিক্ষু সংঘরা দীর্ঘ তিন মাস বর্ষাবাসযাপন করে আজ তার সমাপ্তি ঘটাচ্ছেন। দিনের কর্মসূচি শুরু হয়েছে ভোরে, বিশ্বশান্তি কামনায় বিশেষ সূত্র পাঠের মধ্য দিয়ে। সকালে উত্তোলন করা হবে বিহার প্রাঙ্গণে জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা। দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশু-কিশোরদের কলকাকলিতে বিহার হয়ে উঠবে মুখরিত। পল্লী অঞ্চলে দায়ক-দায়িকারা বিহারে এসে পঞ্চশীলে প্রতিষ্ঠিত হবে। কেউ কেউ অষ্টশীলও গ্রহণ
করবেন। এরপর উৎসর্গ করা হবে বুদ্ধপূজা। বিহারে ধর্মীয় আলোচনা শেষে শুরু হবে সম্মিলিত প্রার্থনা। শরবতী পূজা করার পর উৎসর্গ অনুষ্ঠান চলবে প্রার্থনার মাঝে। নানা ঝলমলে বাতি দিয়ে বিহারে যখন আলোকসজ্জা করা হবে তখন এক অনুপম দৃশ্যের অবতারণা হবে। তখন বিহার সবাইকে আহ্বান জানাবে এভাবে_ 'এসো হে ক্লান্ত ও শান্ত মানুষেরা, ক্ষণিকের জন্য হলেও নিজেকে ধর্মীয় আবেশে জড়িয়ে শান্তির পরশ নাও। এখানে ছাড়া আর কোনোখানে শান্তি পাবে না। আর আজকের মতো দিন এলেও আগামীতে তুমি নাও থাকতে পার নিজ স্বজনের কাছে। কাজেই দেরি করছো কেন, এসো নিজে ধন্য হও, অপরকে এ পথে নিয়ে এসো। ধর্মীয় বাণীই পারে সকল অকুশল দূর করে দিতে।'
দেশব্যাপী বিহারগুলোতে পালাক্রমে শুরু হচ্ছে দানোত্তম কঠিন চীবর দান। পুণ্যময় এ দান চলবে প্রায় এক মাস। এ দান অনুষ্ঠান মহামিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কাপড় তৈরি করে চীবর সেলাইসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে এ দান অনুষ্ঠান করার বিধান থাকলেও নানা প্রতিকূলতার কারণে সে ব্যবস্থা পালন করা যায় না। বাংলাদেশে একমাত্র রাঙামাটির রাজবন বিহারেই ধর্মীয় বিধান মোতাবেক কাপড় তথা চীবর তৈরি করে দান করা হয়। কঠিন চীবর দানের ফলের সঙ্গে আর কোনো দানের ফলের তুলনা হয় না। এ কারণে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এ দানকে 'দানোত্তম কঠিন চীবর দান' হিসেবে অভিহিত করেছে। বুদ্ধ একবার তার পাঁচশ' অরহত শিষ্যসহ হিমালয়ের পুকুরের কাছে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি তার শিষ্য নাগিত স্থবিরকে কঠিন চীবর দানের ফল সবাইকে শোনাতে বললেন। নাগিত স্থবির দানের ফল বর্ণনা করার পর বুদ্ধ নিজে আরও কিছু সুফল উপস্থিত অরহত ভিক্ষুদের বললেন।
এ দান শ্রেষ্ঠ দান। এ দানের ফলে দাতা দেবলোকে দেবব্রহ্মরূপে এবং মানবকুলে রাজচক্রবর্তীরূপে জন্মলাভ করে। দাতাকে নীচুকুলে জন্ম নিয়ে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয় না। জগতে যত রকম দান আছে তার মধ্যে কঠিন চীবর দানের ফল সবার ঊধর্ে্ব। বুদ্ধ, সম্যক সম্বুদ্ধ এবং শ্রাবক সংঘ এ দানের ফল অপরিমেয় বলে স্বীকার করেছেন। এসব মহাফল জেনে সব মানুষ শ্রদ্ধাচিত্তে দানোত্তম কঠিন চীবর দান করুক_ এটিই বুদ্ধের উপদেশ। এ দানের চারটি বিষয় লক্ষণীয়।
ক. শীলবান দাতা শীলহীন গ্রহীতাকে দান করলে তা দাতার শীলগুণের প্রভাবে শুভ ফলদায়ক হয়। খ. দুঃশীলদাতা যদি শীলবান গ্রহীতাকে দান করে, তাতেও শীলবান গ্রহীতার শীলগুণের কারণে তা দাতার জন্য ভালো ফল বয়ে আনে। গ. দাতা ও গ্রহীতা উভয়েই শীলবান হলে উভয়পক্ষের শীলগুণের প্রভাবে তা উভয়ের জন্য মহামঙ্গলময়। ঘ. দাতা ও গ্রহীতা উভয়ে দুঃশীল হলে সে দান কোনো পক্ষের জন্য শুভ ফল বয়ে আনে না। পক্ষান্তরে সে দান দুঃখও বয়ে আনে না।
দান সবসময় কায়মনোবাক্যে করতে হয়। লৌকিকতাপূর্ণ দানের কোনো সুফল নেই। শ্রদ্ধাপূর্ণ দানের ফল অনাবিল সুখ বয়ে আনে। এর প্রভাবে দাতা প্রতিরূপ দেশে জন্ম নিয়ে সৎসঙ্গ লাভ করেন। জন্ম-জন্মান্তরে সৎ জীবনযাপনে সমর্থ হন। এখানে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে। দানীয় কর্ম তো আমরা সবাই করছি। ফল পাচ্ছি কি-না জানি না। তবে দাতা-গ্রহীতার লক্ষ্য সুসময়ে ঘটলে ফল অবশ্যই আশা করা যায়। বর্তমান ক্ষণটা আমাদের জন্য অনুকূল নয়। এ মুহূর্তে বুদ্ধ বাণীর কোনো বিকল্পও নেই। ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অশান্ত ক্ষণটাকে শান্ত করার জন্য যে যার অবস্থানে থেকে প্রচেষ্টা চালালে আমাদেরই মঙ্গল হবে। পরিশেষে, আজকের শুভ প্রবারণা ক্ষণে সবাইকে জানাই শুভবাদ। সবার জন্য অনাবিল আনন্দ বয়ে আসুক_ এ কামনাই করছি। বাংলাদেশ লাভ করুক সমৃদ্ধি, জগতের সব প্রাণীর সুখ হোক।

No comments

Powered by Blogger.