জেলে হারুনের ‘তেল-চিকিৎ সা’! by এম জসীম উদ্দীন

মাস তিনেক আগেও হারুন মিয়া বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এলাকায় এখন তিনি হারুন হুজুর নামে পরিচিতি পেয়েছেন। তাঁর দাবি, সাগরে পাওয়া বিশেষ পাথরের গুণে যেকোনো রোগ সারিয়ে তুলতে পারেন তিনি।
তাঁর ‘চিকিৎ সা’ নিতে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে শত শত নারী-পুরুষ ভিড় জমাচ্ছেন বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের সাঝিপাড়া গ্রামে। হারুনকে কেন্দ্র করে গ্রামের একটি চক্র এ সুযোগে প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার


টাকা। গত বুধবার সকালে সাঝিপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎ সা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন বেশ কয়েকজন নারী। সবার হাতে হারুনের দেওয়া সরিষার তেল, কালিজিরা ও গোলাপজল। রাস্তার পাশে সরিষার তেল, কালিজিরা, গোলাপজল নিয়ে পসরা বসিয়েছেন পাঁচ-ছয়জন। এ ছাড়া খাবারের দোকানও রয়েছে বেশ কয়েকটি। হারুনের সহযোগী (খাদেম) খোকন নামের এক ব্যক্তি জানান, প্রতিদিন গড়ে ১০০-১৫০ জন রোগী আসেন। প্রতি বুধবার ৪০০-৫০০ রোগী আসেন।
উঠানে দাঁড়াতেই ঘর থেকে মানুষের চিৎ কার শোনা গেল। জানতে চাইলে উপস্থিত একজন জানালেন, তেল মালিশ চলছে। বারান্দায় বিছানো হোগলার ওপর চারজন বৃদ্ধ উদোম হয়ে শুয়ে আছেন; তিনজন উপুড় হয়ে আর একজন চিৎ হয়ে। প্রত্যেকের শরীরে তেল মাখানো। একটু পরই ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন হারুন। এবার একজনের ঘাড় থেকে শুরু করে পিঠের অংশে গায়ের জোরে শুরু হলো তেল মালিশ। আর সঙ্গে সঙ্গে গোঙানির শব্দ। এভাবে বাকি তিনজনকেও। সরিষার তেলের মাঝে একটুকরো কালো রঙের পাথর। এবার ঘরের ভেতর থেকে নারীর চিৎ কার। ঢুকে দেখা গেল ভেতরে ২৫-৩০ বছর বয়সী একজন নারীকে বসিয়ে পেছন দিক থেকে গলায় হাত দিয়ে মুখমণ্ডলসহ মাথা ওপরের দিকে টানছেন। আর ওই নারী তাতে তীব্র ব্যথায় চিৎ কার করছেন। পাশেই মাদুরের ওপর বিবস্ত্র চারটি শিশু উপুড় করে শোয়ানো। প্রত্যেকের শরীরেই তেল মাখানো। এবার শুরু হলো শিশুদের মালিশ। উপুড় করে পিঠে সজোরে চাপ দিয়ে মালিশ শুরু করতেই শিশুদের চিৎ কার। এভাবেই রোগীদের তেল-চিকিৎ সা দেন হারুন।
তেল মালিশ করে বারান্দায় শুইয়ে রাখা রায়ভোগ গ্রামের পক্ষাঘাতগ্রস্ত আশ্রাফ আলী (৬৫) বলেন, ‘হুনছি, হুজুরের তেলপড়ায় সব রোগ ভালো অইয়্যা যায়, হেইতে আইছি। তয় বাবা, যে জোরে মালিশ মাজে, হ্যাতে মোর অবস্থা আরও কাহিল অইয়া গ্যাছে।’
স্থানীয় খোকন নামের একজন খাতা-কলম নিয়ে রোগীদের সিরিয়াল দিচ্ছেন। রোগীদের চাপ সামলাতে ছয়জন খাদেমও রেখেছেন হারুন। আমেনা নামের একজন জানান, বুধবার তাঁর নাকে তেল পড়ে দিয়ে পলিপসের চিকিৎ সা করেন হারুন। তবে সুস্থ বোধ না করায় আবার এসেছেন।
সাঝিপাড়া গ্রামের সেকান্দার আলীর ছেলে হারুন মিয়া (৩৫) বলেন, ‘বছর খানেক আগে আমি বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে অজু করার সময় একটি পাথর হাতে ওঠে। পরে রাতে ‘ওনারা, (আকাশের দিকে ইঙ্গিত করেন) আমাকে স্বপ্নে দেখান, এই পাথর সরিষার তেলে ভিজিয়ে মালিশ করলে ও খাওয়ালে যেকোনো রোগ ভালো হয়ে যাবে। পরে মাস তিনেক আগে আমি গোপনে নিজ বাড়িতে চিকিৎ সা দিতে শুরু করি। এ খবর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের গ্রামের রোগীরা আমার কাছে আসতে থাকেন। রোগী বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় আলতাফ হোসেন নামের এক মাদ্রাসাশিক্ষক তাঁর একটি পরিত্যক্ত ঘর আমাকে দেন সেখানে বসে রোগীদের চিকিৎ সার জন্য। রোগীরা খুশি হয়ে যে যা দেন, আমি তা-ই নিই। তা দিয়েই আমার সংসার চলে।’ পরিমাণ জানতে চাইলে হারুনের পাশে থাকা দুই খাদেম বলেন, ‘১০০-২০০ টাকা করে দেয় রোগীরা। এ ছাড়া চাল-ডাল, মুরগি ও কাপড়চোপড়ও দেয় অনেকে।’ হারুন জানান, তিনি লেখাপড়া জানেন না।
স্থানীয় কয়েকজন নাম গোপন রাখার শর্তে জানান, হারুনের সহযোগীরা (খাদেম) নানাভাবে প্রচার চালিয়ে রোগীদের প্রলুব্ধ করেন। বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগের চিকিৎ সক গোলাম সগীর বলেন, বাতজনিত ব্যথায় তেল মালিশের ফলে সাধারণত শিরায় রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক হয়। এতে রোগী কিছু সময়ের জন্য উপশম বোধ করে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের দীর্ঘ সময়ের উন্নত থেরাপি দিলে ভালো হতে পারে। তেল মালিশে এ রোগ ভালো হওয়ার নয়।

No comments

Powered by Blogger.