স্বাধীনতার চার দশক-বাংলাদেশ এখন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নয় by এ কে খন্দকার

‘স্বাধীনতা’—বাঙালি জাতির জন্য এই শব্দটি অতীব গর্বের, পরম শ্রদ্ধার, গভীর প্রত্যাশার; কিন্তু একই সঙ্গে অপরিসীম বেদনার। তাই বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মহান স্বাধীনতার চার দশক পূর্তিতে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি লাখ লাখ শহীদকে, বীরাঙ্গনা মা-বোনদের এবং দেশের আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যাঁদের অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এ স্বাধীনতা। আজ কৃতজ্ঞচিত্তে শ্রদ্ধা নিবেদন করি জাতির জনক


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি, যিনি এই দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে স্বাধীনতার জন্য তিনি নিরলস সংগ্রাম করেছেন এবং অবশেষে জাতিকে সংগঠিত করে দেশকে মুক্ত করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে বাংলাদেশ আর্মস ফোর্সের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে উত্তাল সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে গর্বে বুক ভরে যায় এই ভেবে যে অসমসাহসী বাঙালি জাতি কী দুর্বার শক্তিতে পরাভূত করেছে শক্তিশালী শত্রুপক্ষকে। আজ সেই মুক্তিবাহিনীর ক্ষুদ্র অংশীদার আমি নিজে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আজ নিজেকে প্রশ্ন করি, আমরা কতদূর এগোলাম?
স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংগ্রাম শুরু করেছিলেন ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে। যুদ্ধবিধ্বস্ত, নবীন বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রণীত হয় প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, সাধ ও সাধ্যের সমন্বয়ে নেওয়া হয় বিভিন্নমুখী উন্নয়ন কর্মসূচি। কিন্তু সেই পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের সুফল দেখার সৌভাগ্য জাতির জনকের হয়নি। তবে তিনি চলে গেলেও বাঙালি জাতি সংগ্রাম করে চলেছে তাঁর স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে।
৪০ বছর পর আজ আমাদের অর্জন আর ব্যর্থতার খতিয়ান যদি নিই, তবে দেখব আমাদের অগ্রগতি অনেক এবং বহুমুখী। আমাদের অর্জন আরও বেশি হওয়া সম্ভব ছিল কি না, সেই বিতর্কে আজ না-ই বা গেলাম। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র খেতাবে যারা বাংলাদেশকে ভূষিত করেছিল এক দিন, যারা ভেবেছিল শতকরা ৩ ভাগ হারে ক্রমবর্ধনশীল এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের জোগান দিতে হিমশিম খাবে বাংলাদেশ, তাদের বাঙালি জাতি দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নয়, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, এক দশক ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ শতাংশ হারে হচ্ছে, আমাদের রপ্তানি আয় ২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, এমনকি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময়ও আমরা নিজেরাই আমাদের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ছিল মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ ভাগ। সেই দারিদ্র্যের হার এখন ৩১ ভাগ। উন্নয়নের গতিধারায় আমাদের স্বনির্ভরতার প্রমাণ বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে যে বাংলাদেশে মোট আমদানি হিসাবের ৭১ ভাগ ছিল বৈদেশিক সাহায্য, সেই বাংলাদেশে আজ মোট আমদানির হিসাবে মাত্র ৬ শতাংশ আসে বৈদেশিক সাহায্য থেকে। আমাদের অর্থনৈতিক সাফল্যের ক্ষেত্রে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের অবদানের কথা বলতেই হয়। পৃথিবীর নানা দেশে কাজ করে তাঁরা দেশের জন্য প্রতিবছর পাঠাচ্ছেন ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অকৃষি খাতের ভূমিকা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়ে অর্থনীতির গতি চাঙা করেছে। সামাজিক নানা সূচকের দিকে তাকালে দেখব, বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশিত আয়ু ৪৬ থেকে ৭০ বছর হয়েছে, শিক্ষিতের হার ২৪ থেকে উন্নীত হয়েছে ৫৬ ভাগে। মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৬০০ থেকে ৩০০-তে নেমেছে, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নারী-পুরুষের সমতা।
আমাদের এ রূপ নানা অর্জনের পাশাপাশি চ্যালেঞ্জও আছে প্রচুর। মাথাপিছু আয় ৭৫০ ডলার হলেও আয়বৈষম্য বেড়ে চলেছে। তাই প্রবৃদ্ধির ন্যায্য অংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে পৌঁছে দেওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা হাতে নিয়েছি রূপকল্প ২০২১ বা ভিশন টোয়েন্টি টোয়েন্টি ওয়ান। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আগেই মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণ এখন আমাদের মূল লক্ষ্য। আজ সেই লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে চাই ধনী-দরিদ্র সবার সম-অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে, গ্রাম ও শহরের সম-উন্নয়নের মাধ্যমে। আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাই যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কর্মসূচি, যা নিশ্চিত করবে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন।
প্রিয় সুধী, আজকের এই মহতি অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির আসনে যিনি আসীন, নোবেল বিজয়ী সেই অধ্যাপক অমর্ত্য সেন শুধু বিশ্বব্যাপী খ্যাতিমান একজন ব্যক্তি নন, তিনি বাংলাদেশের বিশেষ বন্ধু। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তাঁর একনিষ্ঠ সমর্থনের কথা বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসার প্রজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, নোবেল পুরস্কারের অর্থে গড়া তাঁর প্রতিষ্ঠান প্রতীচী ট্রাস্টের আওতায়, তিনি বাংলাদেশকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এই প্রতিষ্ঠান শিক্ষা, উন্নয়ন, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা এবং নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। প্রতীচী ট্রাস্টের কর্মপরিধিতে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ জানাই, অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, ভারত সরকার এবং জনগণের সহযোগিতা ও সহমর্মিতার জন্য আবারও তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের সুবাদে এখন আমরা একত্রে উদ্যাপন করছি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম বার্ষিকী।
আজকের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক অধ্যাপক রেহমান সোবহানের প্রতি রইল বিশেষ কৃতজ্ঞতা, বর্তমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে, তাঁর দিকনির্দেশনার জন্য। এই দেশের অগণিত মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের আপামর জনসাধারণ যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে, বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশকে চেয়েছিলেন, সেই বাংলাদেশ আমাদের পেতেই হবে। এই দেশের সাহসী মানুষ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা এনেছে, আজ সেই বাঙালির লড়াই ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, অন্যায়-অবিচার, অশিক্ষা-দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই সংগ্রামেও আমরা জয়ী হব নিশ্চয়ই। আসুন, যে যেখানেই আছি দেশকে ভালোবেসে দেশের স্বার্থে সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাই।

শুক্রবার জাতীয় জাদুঘরে সিপিডি, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র আয়োজিত ‘একাত্তরের ভাবকল্প ও চার দশকের যাত্রা’ শীর্ষক স্মারক অনুষ্ঠানে দেওয়া প্রধান অতিথির ভাষণ
এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার: পরিকল্পনামন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান।

No comments

Powered by Blogger.