শ্রদ্ধাঞ্জলি শাহ এএমএস কিবরিয়া by মোনায়েম সরকার

২৭ জানুয়ারি ২০০৫, রাত ৮টায় যখন সেই দুঃসংবাদ এলো, বিশ্বাসই হচ্ছিল না। কিবরিয়া সাহেবের তো হবিগঞ্জ থেকে ফিরে শুক্রবার সকালে আমাকে নিয়ে অফিসে বসে ‘মৃদুভাষণে’র কভার ডিজাইন ফাইনাল করার কথা।
৩১ জানুয়ারি সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ আয়োজিত সেমিনারে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সংস্কার’ বিষয়ে সেখানে তাঁর মূল প্রবন্ধ পাঠ করার কথা। বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি এ নিয়ে সিরিয়াস লেখালেখি করছিলেন চির প্রয়াণের শেষের দিনগুলোতে। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানও চেয়ে নিয়ে এ বিষয়ে তাঁর একটি লেখা ছাপালেন শেষ যাত্রার আগের দিন। আমি প্রস্তাব করেছিলাম, এ বিষয়ে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে একটা সেমিনারও করি। তিনি রাজি হয়েছিলেন। সেমিনার পেপার তৈরি করলেন। মস্তিষ্ক খুব সক্রিয় ছিল। ওই বয়সেও দ্রুত লিখতে পারতেন শামস কিবরিয়া। তাঁর ইংরেজী লেখাও ছিল চমৎকার। সারাজীবন ইংরেজী ভাষায় লিখতেন দেশে-বিদেশে। চির অভ্যাস মতো তিনি সেমিনার পেপার বাংলা এবং ইংরেজীতে তৈরি করে দিয়ে গেলেন। ফোনে তাঁর সঙ্গে সেমিনারের প্রস্তুতি নিয়েও কথা হলো। কিন্তু সিরডাপ মিলনায়তনে ৩১ জানুয়ারি সেমিনার আর করা হয়নি।
১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল শাহ এএমএস কিবরিয়ার নেতৃত্বে। তাঁর ইচ্ছায় আমি ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক পদের দায়িত্ব নিই। ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার ১০ বছরে অসংখ্য সেমিনার করেছি তাঁর নেতৃত্বে। মনোগ্রাফ, পুস্তক-পুস্তিকাসহ ২৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে ফাউন্ডেশন থেকে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ওপর ২২ পর্বের সিডি-ডিভিডি নির্মিত হয়েছে। শামস কিবরিয়ার উৎসাহ ও প্রেরণায় বঙ্গবন্ধুর জীবনীগ্রন্থ প্রকল্পের পান্ডুলিপি তৈরির কাজও সম্পন্ন করেছিলাম আমরা। বাংলা একাডেমীর সঙ্গে চুক্তি মোতাবেক দেরিতে হলেও একাডেমী ২০০৮ সালের বই মেলায় তা প্রকাশ করেছিল। বইটির মুদ্রিত ৩,৫০০ কপি ইতোমধ্যে বিক্রি শেষ হয়েছে।
সফল আমলা জীবন শেষে ১৯৯১-এ তাঁর আওয়ামী লীগে যোগদানের পেছনে আমারও বিশেষ ভূমিকা ছিল। শেখ হাসিনা তাঁকে দলের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য করতে দ্বিধা করেননি। তিনি সভানেত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা পদের দায়িত্বে আসীন হন তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞার গুণে। ১৯৯৬ ও ২০০১-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় দলের পক্ষ থেকে মেধা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। সেসময় কাছ থেকে দেখেছি তার বুদ্ধিমত্তা, ধৈর্য, বলার ও বোঝানোর ক্ষমতা। ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে এসে আওয়ামী লীগ তাকে অর্থমন্ত্রী বানিয়ে যে ভুল করেনি গোটা জাতি এখন স্বীকার করে।
‘মৃদুভাষণ’ বের করার সময় তিনি আমার ওপরই নির্ভর করতেন বেশি, বলতেন- যাদের নেয়া হলো, আপনিই তো তাঁদের ভালো করে চেনেন। আমি হয়ত কাজের মধ্য দিয়ে চিনব। তিনি অল্প দিনেই তাঁদের চিনলেন, তাঁদের যোগ্যতায় আস্থা রাখলেন। ‘মৃদুভাষণ’ অফিসে এলে প্রায়ই আমাকে যেতে বলতেন, বিদেশে গেলে বলতেনÑ আপনি সব দেখবেন।
কিবরিয়া ভাইয়ের শরীর ভাল যাচ্ছিল না। দেশে ও বিদেশে তার চিকিৎসা চলছিল। আমাদের উৎকণ্ঠা ছিল। আবারও নির্বাচনে দাঁড়ানোর দৃঢ় মনোভাব ছিল তাঁর। আমি কিবরিয়া ভাইকে বলেছিলাম, নির্বাচন না করে ’৯৬ সালের মতো অর্থমন্ত্রী হতে পারেন। তিনি বলেছিলেন, ‘সরকার সাহেব, এমপি না হয়ে মন্ত্রী হলে অন্যেরা করুণার দৃষ্টিতে দেখে।’ আমি বলেছিলাম, ২০০১ সালে নির্বাচন করে এমপি হয়েছেন। দেশ নিয়ে, দেশের ভবিষ্যত নিয়ে গভীর উৎকণ্ঠা ছিল। তিনি বলতেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার না হলে জনগণ চাইলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারবে না। হরতালে তাঁর ব্যক্তিগত আপত্তি ছিল; তারপরও তিনি বলতেন, ওরা যা করছে তাতে হরতাল ছাড়া করবেনটা কী! বেগম জিয়ার সরকারকে তিনি বলতেন, ‘টেফ্লন সরকার’। বলতেন, এর গায়ে কোন কিছুই যেন লাগছে না, সব পিছলে যাচ্ছে। দেশে মৌলবাদী উত্থানের শঙ্কা তার মনে ছিল পুরোপুরি। বলতেন, মোনায়েম সাহেব, আপনি তো গ্রামে যান না। তাই বুঝতে পারছেন না, ভেতরে ভেতরে কী সর্বনাশ হয়ে চলেছে। গ্রাম-গঞ্জে সন্ত্রাসী মৌলবাদীরা মসজিদ ও মাদ্রাসাভিত্তিক ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। ক্ষমতায় গেলেও আমরা এই নেতিবাচক পরিবর্তনের ধারা ঠেকাতে পারব কি-না কে জানে! মাঝে মাঝে খুব হতাশও হয়ে পড়তেন। বলতেন, চলেন দেশ-টেশ ছেড়ে চলে যাই। ওরাই থাকুক এদেশে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা হামলায় কিবরিয়া ভাইয়ের সতর্কবাণীর কথা স্মরণ হয়েছিল।
শামস কিবরিয়ার মৃত্যু গোটা জাতিকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বিদেশেও তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর মতো একজন সজ্জন মানুষকেও যদি এভাবে হত্যা করা হয়, তাহলে এদেশে কে নিরাপদ? দেশের ভবিষ্যতই বা কী? কে একজন যেন বললেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার চাইতেও বেশি প্রতিক্রিয়া ও সহানুভূতির জন্ম দিয়েছে কিবরিয়া হত্যাকা-। তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হলে নিশ্চয়ই এতটা হতো না। লোকে খুব জানতেও আগ্রহী হতো না তিনি কী ছিলেন, কতটা ছিলেন, দেশের জন্য কী কী অবদান রেখে গেছেন। মেধাবী ছাত্র, রাষ্ট্রদূত, পররাষ্ট্র সচিব, অর্থনীতিবিদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী এসব অভিধা ছাড়িয়ে তিনি একজন প্রাজ্ঞ দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দার্শনিক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তাঁর নৃশংস হত্যাকা-ে উদ্বেলিত হয়েছে জাতি ও বিশ্ব জনমত। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেমে এসেছে রাস্তায়। সরব প্রতিবাদও জানানো হয়ে একের পর এক হরতাল করে। দেশের বিশিষ্টজনেরা নতুন করে নেমে এসেছিলেন প্রতিবাদে। শাহ এএমএস কিবরিয়ার মতো মানুষের হত্যাকা-ে তাঁরা বুঝতে পারছেন দেশ কোনদিকে যাচ্ছে। কিবরিয়া পরিবারের সদস্য বিশেষ করে আসমা ভাবী, ড. রেজা ও ড. নাজলী শোককে শক্তিতে পরিণত করে দেশে-বিদেশে যে সাহসী প্রতিবাদী ভূমিকা রাখছেন, তা কিবরিয়া ভাইয়ের আপোসহীন সংগ্রামী ভূমিকারই প্রতিফলন ঘটাচ্ছে।
২০০৫-এর সূচনায় প্রিয় কিবরিয়া ভাইয়ের মৃত্যু, ক্ষণজন্মা কিবরিয়ার আত্মদান জাতিকে স্বাধীনতার মূল ধারায় অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে পুনর্¯’াপনে শক্তি যোগাবেÑএ বিশ্বাসই এখন আমাদের পথ দেখাচ্ছে। কিবরিয়া ভাইয়ের আদর্শ আমাদের নিরন্তর প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিক

No comments

Powered by Blogger.