সমস্যার আবর্তেই বছর পার করল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় by আযাদ আলাউদ্দীন

২৪ জানুয়ারি ছিল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। ২০১২ সালের ওই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিাকার্যক্রম শুরু হয়েছিল। কিন্তু এক বছরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক, আবাসন, শ্রেণিক আর গবেষণাগারের সঙ্কট সমাধান হয়নি।
অভিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ শিক ছাড়া উচ্চশিার মানোন্নয়ন বা মান ধরে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু পদ থাকলেও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ওই ধরনের শিক পাচ্ছে না। কারণ বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শিকেরা নতুন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে চান না। জানা গেছে, বরিশাল নগরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কীর্তনখোলা নদীর পূর্ব পাড়ে সদর উপজেলার কর্ণকাঠি গ্রাম। ওই এলাকার অধিগ্রহণকৃত ৫০ একর জমিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠোমোসহ ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। তবে শুরু থেকেই বরিশাল জিলা স্কুলের একটি ভবনে ছয়টি বিভাগে ৪০০ শিার্থী ও ১৮ জন শিক নিয়ে শিা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বর্তমানে শিার্থীর সংখ্যা এক হাজার ১০০ আর শিক ৩৬ জন। আশ্চর্যের বিষয়, এই উচ্চ শিাপ্রতিষ্ঠানে একমাত্র ভিসি ও রেজিস্ট্রার ছাড়া অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক কিংবা সহকারী অধ্যাপক পদমর্যাদার কোনো শিক নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগের সংখ্যা ১০টি। ভিসি একাই রয়েছেন পাঁচটি অনুষদের সব ক’টির ডিনের দায়িত্বে। এ ছাড়া ১০টি বিভাগের নয়টির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। তবে মাঠপর্যায়ে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন প্রভাষকেরাই। যদিও তারা এর জন্য বাড়তি কোনো ভাতা পান না। অভিযোগ উঠেছে, ভিসি একাই একাধিক পদে আকড়ে থাকতে জ্যেষ্ঠ শিক নিয়োগ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না তিনি। এ অবস্থায় অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে এক বছর বয়সী এই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রম চলছে ঢিমেতালে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি অনুষদে ১০টি বিভাগ রয়েছে। অনুষদগুলো হচ্ছেÑ বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, কলা, সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় অনুষদ। জানা গেছে, গণিত ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে পাঁচজন করে প্রভাষক রয়েছেন। অর্থনীতি ও মার্কেটিং বিভাগে চারজন করে, ম্যানেজমেন্ট স্টাডি, পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম ও সয়েল সাইন্স বিভাগে তিনজন করে প্রভাষক রয়েছেন। বাংলা বিভাগ চলছে দুইজন প্রভাষক দিয়ে। এ ছাড়া ইংরেজি বিভাগে পাঁচজন শিকের মধ্যে একজন সহযোগী অধ্যাপক ও অন্যরা সবাই প্রভাষক হিসেবে কর্মরত। বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন ড. মো: মহসিন উদ্দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র সহযোগী অধ্যাপক ড. মো: মহসিন উদ্দিনকে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি পাঠদান থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো আবাসিক হল নেই। ফলে ১১ শ’ শিার্থীর ভরসা এখন মেসবাড়ি। ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা শিক্ষার্থী আমেনা বেগম, ফারহানা আক্তার ও হাবিবুর রহমান বলেন, হল না থাকায় তাদের কষ্ট করে মেসে থাকতে হচ্ছে। হল নির্মিত হলে আবাসন সঙ্কট কেটে যাবে। তারা বলেন, মেসবাড়ির খাবারের মান ভালো নয়। জানা গেছে, ছাত্রছাত্রীদের জন্য পৃথক হলের নির্মাণকাজ চলছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণিকরে সঙ্কট প্রকট। প্রত্যেক বিভাগের জন্য একটি করে শ্রেণিক বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু নতুন ব্যাচের কাস শুরু হওয়ায় একটি করে ব্যাচ বাইরে অবস্থান করে, আর অন্য ব্যাচের কাস চলে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক জানান, শ্রেণিকরে অভাব থাকায় দুই পালায় কাস নেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত কর্ণকাঠিতে নতুন অ্যাকাডেমিক ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। ভবনের কাজ শেষ হলেই শ্রেণিকরে সঙ্কট শেষ হওয়ার কথা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০টি বিভাগে কোনো অধ্যাপক কিংবা সহকারী অধ্যাপক নেই। তবে একজন সহযোগী অধ্যাপক রয়েছেন। জ্যেষ্ঠ শিক না থাকায় গবেষণা কার্যক্রম চালু হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। এ ছাড়া এক বছরেও কোনো গবেষণাগার স্থাপন করা হয়নি। গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দও করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়নি কোনো জার্নাল। তবে এই বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে একটি জার্নাল প্রকাশিত হবে বলে শিক সমিতির নেতারা নিশ্চিত করেছেন। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় শিক সমিতির সভাপতি শফিউল আলম বলেন, প্রভাষকদের মধ্যে বেশির ভাগই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শিকতা জীবন শুরু। সিলেবাস, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে গিয়ে তারা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, একজন অধ্যাপক ঢাকায় যে সুযোগ-সুবিধা পান, এখানে তা নেই। তা ছাড়া নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এখানো কোনো গবেষণাগার, গ্রন্থাগার ও শিকদের আবাসন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে এখানে জ্যেষ্ঠ শিক আসতে চান না।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় রিজেন বোর্ডের সদস্য ও ইউজিসির উপসচিব মো: ফেরদৌস জামান বলেন, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বেশ সঙ্কট রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সঙ্কটগুলো পর্যায়ক্রমে কেটে যাবে। জ্যেষ্ঠ শিক না থাকায় পাঠদানে ব্যাঘাত ঘটার কথা স্বীকার তিনি বলেন, দুই বছর পর প্রভাষকেরাই সহকারী অধ্যাপক পদে পদায়ন পাবেন। পাশাপাশি অধ্যাপক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. হারুনর রশীদ খান বলেন, পাঁচটি অনুষদের জন্য অধ্যাপক চেয়ে একাধিকবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত নন এমন চাকরিপ্রার্থীরা আবেদন করছেন। কিন্তু আমরা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢাকা আর চট্টগ্রামের সাথে রাখতে চেষ্টা করছি। তাই যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় জ্যেষ্ঠ শিকদের পদগুলো শূন্য রয়েছে। তিনি আরো বলেন, আবাসন ও শ্রেণিকরে সঙ্কট নতুন ভবন হলেই মিটে যাবে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় মূলত আবর্তিত হয় জ্ঞানের গভীরতা দিয়ে। এ জন্য অভিজ্ঞ, বয়োজ্যেষ্ঠ শিকের বিকল্প নেই। অভিজ্ঞ শিক না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত রূপ ফুটে ওঠে না। কিন্তু সমস্যা হলো শিকেরা নানা কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম থেকে ছোট শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চান না। এ সমস্যা থেকে উত্তরণ কঠিন উল্লেখ করে ইউজিসির চেয়ারম্যান বলেন, বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিকদের স্বল্প সময়ের জন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেপুটেশনে পাঠানো যায় কি না, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। এ জন্য শিকদের ডেপুটেশন ভাতা, বাসা ভাড়াসহ বিভিন্ন প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা করারও চিন্তা চলছে, যাতে শিকেরা যেতে আগ্রহী হন। এ দিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে সিটি করপোরেশনের মেয়র শওকত হোসেন হিরনের নেতৃত্বে বৃহস্পতিবার নগরীতে আনন্দ মিছিল বের করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
       

No comments

Powered by Blogger.