দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অনুমোদনের প্রক্রিয়া তদন্ত করবে সংসদীয় কমিটি- বাতিলযোগ্য দরপত্র গ্রহণযোগ্য দেখিয়ে ক্রয় কমিটিতে পাস! by অরুণ কর্মকার

বাতিলযোগ্য দরপত্র বিধিবহির্ভূতভাবে গ্রহণযোগ্য (রেসপনসিভ) দেখানোর তথ্য গোপন করে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি থেকে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপনের অপেক্ষায় আছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির কাছে এ-সংক্রান্ত অভিযোগ রয়েছে। সংসদীয় কমিটি বিষয়টি তদন্ত করার উদ্যোগ নিচ্ছে। গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির সভায় অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি এ বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে।
ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিও তাদের অনুমোদন-পরবর্তী প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে। দুটি কাজের ক্ষেত্রেই কোম্পানিগুলোর স্থানীয় এজেন্টদের রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগানো হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবেই বাতিলযোগ্য দরপত্র গ্রহণযোগ্য করা হয়েছে।
কেন্দ্র দুটির মধ্যে কয়লাভিত্তিক বড়পুকুরিয়া ২৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি স্থাপনের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে চীনের হারবিন ইলেকট্রিক ইন্টারন্যাশনাল (এইচইআই) ও এর সহযোগী সিসিসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে। আর ঘোড়াশাল ৪৫০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির জন্য নির্বাচন করা হয়েছে একই দেশের কনসোর্টিয়াম অব চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) এবং সাংহাই ইলেকট্রিক করপোরেশনের (এসইসি) কনসোর্টিয়ামকে।
বড়পুকুরিয়া ২৫০: বড়পুকুরিয়ার ২৫০ মেগাওয়াট সম্প্রসারণ প্রকল্পটির দরপত্র খোলা হয় গত বছরের ১১ জুন। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, দরপত্রের চাহিদা অনুযায়ী হারবিন অভিজ্ঞতার সনদ দেয়নি। যেসব যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ চাওয়া হয়েছে, তার কোনো কোনোটি দেওয়ার কথা দরপত্রে উল্লেখ করেনি। সেগুলোর দামও ধরেনি। এইভাবে তারা দরপ্রস্তাব কম রেখেছে।
বিধান (রিজেকশন ক্লজ) অনুযায়ী, ওই কারণে হারবিনের দরপ্রস্তাব বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এর পরিবর্তে হারবিনের কাছে ওই সব বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে নিয়ে দরপত্র বহাল রেখে সর্বনিম্ন দরদাতা দেখানো হয়। এই বিষয়গুলো ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। ফলে ৯ জানুয়ারি কমিটি সেটি অনুমোদন করে।
পিডিবি সূত্র জানায়, হারবিন এর আগেও যেসব দরপত্রে অংশ নিয়েছে, তার প্রতিটিতে কোনো না কোনো যন্ত্রাংশ সরবরাহের বিষয় উল্লেখ না করে প্রস্তাবিত দর কম দেখিয়ে কাজ নিয়েছে। এবারও হারবিন কাজটির জন্য আর্থিক মূল্যায়নে যোগ্য বিবেচিত না হলেও তাদেরই কাজটি দেওয়ার জন্য বিভিন্ন কৌশল করা হচ্ছিল।
এই অবস্থায় যোগ্য বিবেচিত সিএমসি-এসইসি কনসোর্টিয়াম পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটে (সিপিটিইউ) অভিযোগ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সিপিটিইউ অভিযোগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত দরপত্রের প্রক্রিয়া বন্ধ রাখতে বলে।
আইএমইডি সূত্র জানায়, পরে সিএমসি তাদের অভিযোগ প্রত্যাহার করে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হারবিন ও সিএমসির স্থানীয় এজেন্ট সমঝোতায় পৌঁছে অভিযোগ প্রত্যাহার করে। ফলে বড়পুকুরিয়া কেন্দ্রটির জন্য হারবিন নির্বাচিত হয়।
ঘোড়াশাল ৪৫০: এই কেন্দ্রের জন্য আহূত দরপত্রও খোলা হয় গত বছরের জুন মাসে। সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল সাংহাই ইলেকট্রিক করপোরেশন নামের একটি কোম্পানি। কিন্তু সর্বনিম্ন দেখানো হয় সিএমসি-সিএনটিআইসি কনসোর্টিয়ামকে। অথচ সিএমসির দরপত্রে প্রথমে প্রকল্পের জন্য কত অর্থ দরকার হবে, তার উল্লেখ ছিল না। কেন্দ্রটির ‘ওয়ারেন্টি পিরিয়ডে’ খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহের উল্লেখ করা হয়নি। এগুলো সবই দরপত্র সরাসরি বাতিল করে দেওয়ার বিধানের আওতায় পড়ে। এ কারণে পিডিবি দরপরত্রটি বাতিলও করেছিল।
কিন্তু পরে অজ্ঞাত কারণে এগুলো সম্পর্কে সিএমসির কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়, যা দরপত্রের বিধিবহির্ভূত। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় পিডিবির কাছে ব্যাখ্যা চাইলে পিডিবি জানায়, অংশগ্রহণকারী দুটি কোম্পানির কাছেই সমতার ভিত্তিতে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু যে কোম্পানির দরপত্র রিজেকশন ক্লজের মধ্যে পড়ে, তাদের কাছে এ ধরনের ব্যাখ্যা চাওয়া বিধিবহির্ভূত।
এই বিষয়গুলোও ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার কাছে গোপন রাখা হয়েছে। এই প্রকল্পও ৯ জানুয়ারি কমিটির অনুমোদন পায়।
সরকারি সূত্র জানায়, এখন বিভিন্ন মহল থেকে বিষয়গুলো কমিটির সদস্যদের নজরে আনা হচ্ছে। কারণ, এসব বিষয়ে ভবিষ্যতে মামলা হওয়া প্রায় নিশ্চিত। তাই সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিষয়গুলো ভেবে দেখছেন। আপাতত প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য তা উপস্থাপন করা হচ্ছে না।
সংসদীয় কমিটি: গতকালের সভায় বিদ্যুৎ খাতের আট-নয়টি অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আলোচনার পর সেগুলো তদন্তের জন্য উপকমিটিতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু উপরোক্ত দুটি পাঠানো হয়নি। কারণ, সেগুলোর স্থানীয় এজেন্টদের সঙ্গে কোনো কোনো সাংসদেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে সভার সূত্র জানায়।
কমিটি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের উপস্থাপিত একটি প্রতিবেদন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের তালিকায় এমন কেন্দ্রেরও উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো নির্মাণের জন্য কেবল চুক্তি করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট পাঁচ হাজার ৪৩৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্র নির্মাণাধীন থাকার কথা। সংসদীয় কমিটি হিসাব করে বলেছে, প্রকৃতপক্ষে নির্মাণাধীন আছে এক হাজার ১৫৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্র।
সুবিদ আলী ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় বন্ধ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দ্রুত চালু করা, আসন্ন সেচ ও গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি।

No comments

Powered by Blogger.