সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণ-গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনে বিরোধী দল ব্যর্থ

রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান বলেছেন, 'বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা আগামী দিনে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সংসদীয় নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হব।'
বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইঙ্গিত দিয়ে গতকাল রবিবার জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে এ কথা বলেন। তিনি বিরোধী দলের কঠোর সমালোচনা করেন। নবম জাতীয় সংসদের ১৬তম অধিবেশন শুরু হয়েছে গতকাল। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের সংসদ সদস্যরা এ অধিবেশনেও যোগ দেননি। সংসদের শীতকালীন এ অধিবেশন চলবে ৬ মার্চ পর্যন্ত।
সংসদে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি বলেন, বিশেষ অবস্থান আঁকড়ে থেকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত জিইয়ে রাখা কিংবা সংসদ বয়কটের ব্যাপারে অনমনীয় থেকে জনগণের দেওয়া দায়িত্ব পালন না করা গণতান্ত্রিক আচরণের পরিপন্থী। বিরোধী দল চার বছর ধরে সংসদীয় কর্মকাণ্ডে নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণে বিরত থেকে তাদের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
জিল্লুর রহমান বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০১-২০০৬ মেয়াদে ক্ষমতায় এসেই প্রতিহিংসার রাজনীতি শুরু করেছিল। ওই সরকারের ধ্বংসাত্মক রাজনীতি জন্ম দিয়েছিল একটি ভবনকেন্দ্রিক গণবিরোধী তৎপরতার। এতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ। কিন্তু এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ এই বিকৃতি ও বিপথগামিতা সহ্য করেনি। সে কারণেই ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তারা সৃষ্টি করে আরেকটি ইতিহাস।
বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, 'বয়কট, জ্বালাও-পোড়াও আর সংঘাত-নৈরাজ্যের পথ পরিত্যাগ করুন। যাবতীয় অভিযোগ, প্রস্তাব, সুপারিশ ও মতামত সংসদের ভেতরে এসে বলুন এবং গণতন্ত্র বিকশিত হতে সহায়তা করুন।'
রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার তার অন্যতম প্রধান নির্বাচনী অঙ্গীকার হিসেবে আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু করেছে। দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১২টি মামলা বিচারাধীন। একটি মামলায় দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রায় ইতিমধ্যে ঘোষিত হয়েছে। আশা করা যায়, বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে মামলাগুলোর বিচারকাজ সম্পন্ন হবে।
জিল্লুর রহমান বলেন, মানবাধিকার রক্ষায় বর্তমান সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছা রয়েছে। দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির গুণগত ও পরিমাণগত উন্নয়ন হয়েছে। এ সরকারের মেয়াদে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচন বা উপনির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, বর্তমান সরকারের সময়ে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধ কার্যক্রমে ব্যাপক গুণগত ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে ও সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৩৩৫টি অভিযোগ সুষ্ঠুভাবে অনুসন্ধানের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে এক হাজার ৩৯৪টি মামলা রুজু করেছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সুসংহত করতে নেওয়া হয়েছে নানামুখী উদ্যোগ। পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়ন প্রচেষ্টার পাশাপাশি একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সংঘটিত গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জনগণের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ ও অবিভাজিত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা আদায় এবং আটকে পড়া পাকিস্তানিদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে বাংলাদেশ তার দাবি বিভিন্ন পর্যায়ে উত্থাপন করে আসছে। পূর্বমুখী কূটনীতি বাস্তবায়নে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক উষ্ণ রূপ পরিগ্রহ করেছে।
সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে বলে রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেন। গত চার বছরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের সফল পদক্ষেপের ফলে ভারত আলোচিত টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বিষয়ে যৌথ সমীক্ষা পরিচালনায় সম্মত হয়েছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এ-সংক্রান্ত দলিলপত্র বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে বৈদেশিক অর্থায়ন নিয়ে সৃষ্ট সংকট নিরসনের প্রক্রিয়া চলছে বলে রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করেন। বর্তমানে ঠিকাদার নিয়োগ কার্যক্রম চলমান আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ২০১৩ সালের মধ্যেই সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে। প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নে হলেও এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার বদ্ধপরিকর।
রাষ্ট্রপতি বলেন, 'গণতন্ত্রের মানসকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার চার বছর ধরে কঠোর ও নিরলস পরিশ্রম করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই অর্জন করেছে অভূতপূর্ব সাফল্য। আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, এই সমাপনী বছরে সরকারের অবশিষ্ট অঙ্গীকার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।'
বিরোধী দল ছাড়াই শুরু : স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের সভাপতিত্বে গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টায় সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। স্বাগত বক্তব্যে তিনি বিরোধী দলকে সংসদে যোগ দিয়ে জনগণের দেওয়া দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।
বছরের প্রথম অধিবেশনে রেওয়াজ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ভাষণ দেন। এ সময় বিরোধী দল বিএনপি, জামায়াত, বিজেপি ও এলডিপির সদস্যরা অনুপস্থিত ছিলেন। টানা ৭৭ কার্যদিবস বর্জনের পর গত বছরের প্রথম অধিবেশনের শেষ সময়ে ১৮ মার্চ যোগ দিলেও গত তিনটি অধিবেশন তাঁরা বর্জন করেন।
অধিবেশনের শুরুতে স্পিকারের স্বাগত বক্তব্যের পর স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের অনুপস্থিতিতে সংসদ পরিচালনার জন্য সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচন করা হয়। সদস্যরা হলেন অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া, এ বি এম গোলাম মোস্তফা, মুজিবুল হক চুন্নু, জাফরুল ইসলাম চৌধুরী ও এথিন রাখাইন।
এরপর সম্প্রতি প্রয়াত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্মরণে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন স্পিকার। শোক প্রস্তাবের তালিকায় সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দর কুমার গুজরাল, সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মিয়া, এ কে এম শামসুল হুদা অ্যাডভোকেট, কাজী সাহাবুদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ হায়দার আলী, সৈয়দ মোর্শেদ কামাল, আঞ্জুমান আরা জামিল, মুফতি ফজলুল হক আমিনী ও আবু ছালেক, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও রাজনীতিক নির্মল সেন, জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ খান সারওয়ার মুরশিদের নাম উল্লেখ করা হয়। বরেণ্য অন্যান্য ব্যক্তির মৃত্যুতেও গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশের পাশাপাশি প্রয়াতদের আত্মার শান্তি কামনা করে মোনাজাত করা হয়।
শোক প্রস্তাব উত্থাপনের পর আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ রাষ্ট্রপতির জারি করা তিনটি অধ্যাদেশ সংসদে উত্থাপন করেন। রাষ্ট্রপতির ভাষণের পর আগামী ৩০ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি করা হয়।
অধিবেশনে স্বাগত বক্তব্যে জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান স্পিকার আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, 'জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদে এসে জনগণের কথা বলা সংসদ সদস্যদের পবিত্র দায়িত্ব। তাই আমি আশা করব সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা জনপ্রত্যাশা পূরণে এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে অব্যাহত প্রয়াস চালাবেন।' স্পিকার বলেন, 'সংসদকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলের ভূমিকাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি সরকারি ও বিরোধী দলনির্বিশেষে সব সংসদ সদস্যকে সংসদে এসে কার্যকর ভূমিকা রাখার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।'
কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক : সংসদ অধিবেশন শুরুর আগে কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে আগামী ৬ মার্চ পর্যন্ত অধিবেশন চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গতকাল বিকেলে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি স্পিকার আবদুল হামিদ। বৈঠকে কমিটির সদস্য সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, চিফ হুইপ মো. আব্দুস শহীদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মো. ফজলে রাব্বী মিয়া, রাশেদ খান মেনন ও আব্দুল মতিন খসরু উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাব নিয়ে ৪০ ঘণ্টা আলোচনা হবে। অধিবেশন শুরু হবে প্রতিদিন বিকেল সাড়ে ৪টায়। অধিবেশনের মেয়াদ বাড়ানো বা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব স্পিকারের।

No comments

Powered by Blogger.