যুদ্ধাপরাধ মামলায় প্রথম রায় বিএনপির অবস্থান by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের সাবেক রুকন ( কেন্দ্রীয় সদস্য) আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের রায় দিয়েছেন।
এটি যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত মামলার বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়। দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও প্রত্যাশার এই রায়ে গোটা বাংলাদেশ যেন একাত্তর সালের দিনগুলোতে কিছু সময়ের জন্য ফিরে যেতে পেরেছে। সেই সময় একদিকে বাংলার জনগণ মুক্ত স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে লড়াইতে অংশ নিয়েছিল, তেমনি অন্যদিকে আবার কিছু মানুষ নামের ভিন্ন চিন্তাধারার দল ও গোষ্ঠী পাকিস্তানের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস থেকে পাকিস্তানের বাঙালীবিরোধী হত্যাযজ্ঞে বা অপরাধ কর্মের বিরোধিতা না করে বরং প্রত্যক্ষভাবে তাতে সহযোগিতা করেছিল; রাজাকার, আলবদর বাহিনী গড়ে তুলে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িয়ে পড়েছিল। সেই দুঃসহ স্মৃতি বেশিরভাগ মানুষই এখনও ভুলতে পারেনি। তারা অনেক নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, বাড়িঘর পুড়িয়ে সর্বস্বান্ত করতে ভূমিকা রাখে। স্বাধীনতার পর থেকে এসব পরিবার ঐ সব অপরাধীর বিরুদ্ধে কোন বিচার পায়নি, তাদের মনোকষ্ট লাঘব করার সামান্যতম সুযোগ পায়নি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর যদিও বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, কিন্তু ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ওইসব উদ্যোগ বাতিল হয়ে যায়, তামাদি করার চেষ্টা করা হয়। ফলে মনের ভেতর নির্যাতন ও সব হারানোর সকল কষ্ট নিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ চার দশক পাড়ি দিয়ে আসছিল। এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে যুদ্ধাপরাধীদের মধ্য থেকে একজনের বিচারের রায় ঘোষিত হওয়ায় গোটা দেশ যেন আচমকা একাত্তরের স্মৃতিতে জেগে ওঠার সুযোগ পেয়েছে। সর্বত্র মানুষের সন্তোষ প্রকাশের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। একাত্তরের স্মৃতি জাগানিয়া ঘটনা হিসেবে এই রায় একটি বড় ধরনের ভূমিকা পালন করছে। এমন ঐতিহাসিক মুহূর্তকে ভাগাভাগি করে নিতে সকল বয়সের নারী-পুরুষকে তৎপর দেখা যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে একাত্তরের সমগ্র ইতিহাসের প্রতি এক ধরনের দায়বদ্ধতায় নতুন প্রজন্মকে যুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। ইতিহাস সব সময়েই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতু বন্ধনে কাজ করে থাকে, এর ওপর গুরুত্ব আরোপও করে থাকে। খুব দেরিতে হলেও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের ঘটনাবলি আমাদের মধ্যে সেটি তৈরি করার সুযোগ করে দিয়েছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় , বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এই বিচার নিয়েই এক ধরনের দ্বৈতনীতি গ্রহণ করেছে। মুখে বলছে, তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে, কিন্তু কিছু শর্ত এর সঙ্গে জুড়ে দেয়। বলার চেষ্টা করে থাকে যে, বিচারটি যেন হয় স্বচ্ছতার সঙ্গে। বাহ! দারুণ কথা! তারা এ পর্যন্ত এই বিচারে কোন অস্বচ্ছতা দেখেছে কিনা, তার কোন তথ্য-প্রমাণ দিয়েছে বলে কখনও শোনা যায়নি। তা হলে স্বচ্ছতার বিষয়টি বিএনপির ছেলে-বুড়ো সকলেই তোতা পাখির মতো বার বার আওড়াচ্ছে কেন? নিজেরা তো কখনও এ ধরনের বিচারের কোন উদ্যোগ নেয়নি। অথচ নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দল বলে দাবি করছে। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাসহ নানা কিছুতে তাদের দলীয় প্রতিষ্ঠাতার অংশগ্রহণকে বড় করে দেখানোর চেষ্টাও তারা করে থাকে। তবে যেটি তারা অন্যায়ভাবে করে তা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের ভূমিকাকে অস্বীকার কিংবা খাটো করে দেখানোর চেষ্টা। এখানেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার চাইতে এটিকে জবরদখল করার দলীয় মনোবৃত্তি ফুটে ওঠে।
এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আয়োজন যখন চলছে তখন বিএনপি ১৮ দলীয় জোট গঠন করে জামায়াতকে এই বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সাহায্য করে যাচ্ছে, বিভিন্ন জনসভা ও কর্মসূচীতে জামায়াতের বিচারবিরোধী বক্তব্যদানের সুযোগ করে দিচ্ছে। বিএনপি নেতৃবৃন্দ একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই বিচারের বিরুদ্ধে জামায়াতীদের কথা বলার সুযোগও করে দিচ্ছে। বিএনপির এমন অবস্থান সচেতন মানুষের নজরে অনেক আগেই পড়েছে। বিএনপি এই বিচারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে দৃঢ় কোন অবস্থান নিতে পারছে না, আবার বিচারটিকে মনেপ্রাণে গ্রহণও করতে পারছে নাÑ এমন উভয় সঙ্কটে পড়েছে। এর দুটো সহজ ব্যাখ্যা হতে পারে, এক. বিএনপি আন্তরিকভাবেই এই বিচারকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নিচ্ছে না; দুই. এই বিচারের উদ্যোগ নেয়ায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থান বেশ দৃঢ় হচ্ছেÑযা বিএনপিকে দারুণভাবে পরশ্রীকাতরতায় ভোগাচ্ছে। বিএনপি কিছুতেই আওয়ামী লীগের এই কৃতিত্বের সঙ্গে একাত্ম হতে পারছে না। যদিও বিএনপি এ বিচারের সঙ্গে যুক্ত হলে দলগতভাবে লাভবান হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিলÑ দলের নেতাকর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার সুযোগ পেত। বিএনপি আওয়ামী বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান থেকে এই বিচার প্রক্রিয়াতেও যুক্ত হতে পারেনি, বরং মুখে এক কথা অন্তরে অন্য বিশ্বাসের অবস্থানে রয়েছেÑযা দলটির আদর্শগত দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে দিচ্ছে।
গত সোমবার রায় ঘোষণার পর বিএনপি যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে তাকে প্রায় সব কটি পত্রিকাই সতর্ক প্রতিক্রিয়া বলে উল্লেখ করেছে।
বেশিরভাগ বিএনপি নেতাই রায় সম্পর্কে কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে চাননি মিডিয়ার সম্মুখে। অথচ বিএনপির নেতৃবৃন্দ এখন প্রতিদিন দেশের অনেক কিছু নিয়েই কথা বলছেন, আন্দোলন করছেন। কিন্তু এমন একটি ঐতিহাসিক রায় নিয়ে কোন কথা বলতে চাননি বেশিরভাগ বিএনপি নেতৃবৃন্দ। তরিকুল ইসলাম অবশ্য বলেছেন যে, মুক্তিযোদ্ধার দল হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে তার দলের সমর্থন আছে। তবে এখানেও তিনি শর্ত জুড়ে দিয়ে বলেছেন যে, আগে পরের সব মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার তারা চান। এর মানেটি তিনি প্রথম দিন না বললেও পরের দিন একটি আলোচনা সভায় বলেছেন যে, স্বাধীনতার পর তার ভাষায় যে চল্লিশ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে সেটির বিচারও তার দল চায়। কথা হচ্ছে, স্বাধীনতার পর চল্লিশ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে এমন তথ্য-প্রমাণ তার দলের হাতে আছে কী? থাকলে তা বই আকারে প্রকাশ করছেন না কেন? একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সঙ্গে স্বাধীনতা-উত্তরকালের কল্পিত, তথ্য-প্রমাণহীন ৪০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকে একাকার করার বিষয়টি মোটেও সুস্থ মানসিকতা বা অনুকূল রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে না। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কেন, এখনও তো দেশে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- হয়ে থাকে, হত্যাকা- ঘটে থাকে। এগুলোর বিচারে কোন আইনি বাধা আছে কি? এগুলোর বিচারকাজ নিজস্ব গতিতে কমবেশি হচ্ছে। আমাদের দেশে এক সময় অতি-বাম রাজনীতির সবক নিয়ে যারা রাজনীতি করেছে তারা জাতীয় রাজনীতির অনেক কিছুকেই স্বাভাবিক বিচার-বিশ্লেষণে গ্রহণ করেনি। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধকেও তারা জনযুদ্ধের বাস্তবতা থেকে না দেখে ‘দুই কুকুরের লড়াই’, ‘ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী’, ‘রুশ আধিপত্যবাদী’ তত্ত্বে দ্বিধাবিভক্ত করেছিল, দেখেছিল। মুক্তিযুদ্ধকে তারা অতিবিপ্লব অবস্থান থেকে দেখার চেষ্টা করেছে। এরাই মুক্তিযুদ্ধের পর অস্ত্র হাতে নিয়ে জোতদার, পুঁজিপতি খতমের লড়াইয়ে নেমেছিল। তরিকুল সাহেবরা তখন এই সব তত্ত্বে কতখানি বুঁদ হয়ে ছিলেন তা স্মরণ করতে বলব। তাদেরই কোন কোন গ্রুপ আওয়ামী লীগের এমপি, এমএনএ হত্যায় নেমেছিল। যুদ্ধোত্তর দেশে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির ধারা চালু করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া কোন কোন তরুণ অস্ত্র, বিপ্লব, দেশ ও বিশ্ব-বাস্তবতায় সব সময় নিজেকে ঠিক রাখতে পেরেছিলÑএমনটি নয়। বিপ্লবী রোমান্টিকতা সেই ঐতিহাসিক বাস্তবতায় অস্বাভাবিক ছিল না; বরং জাসদসহ বেশ কিছু ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক’ দলের উত্থান, কর্মকা- যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিকাশে বাস্তববাদী ধারায় খুব একটা পরিচালিত হয়নি। তেমন অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক শিক্ষা ছিল না তাদের। তাতে বেশ কিছু স্খলন হয়তো ঘটেছিল। হত্যাকা- কিছু কিছু ঘটেছিল। সশস্ত্র যুদ্ধের পর একটি দেশে এর চাইতে বেশি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলেও নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজ ছিল না। বিষয়গুলো তরিকুল সাহেবরা বোঝেন নাÑতা কিন্তু নয়। খুব ভালভাবেই তারা তা বোঝেন। কিন্তু এখন বিষয়গুলো যখন বলেন, তখন তথ্য-প্রমাণহীনভাবে যেভাবে উপস্থাপন করেন তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের গভীর কোন দরদ ফুটে ওঠে না। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দরদ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি দরদ এতটা উতলা হলো কি করে? মানবতাবিরোধী অপরাধ তো মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের দোসরদের অপকর্মের একটি ঘৃণ্য দিক। সেই বিচারটি বিএনপি ১৯৭৫-এর পর থেকে হতে দেয়নি, যুদ্ধাপরাধীদের জেল থেকে একে একে মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল, মুক্তযুদ্ধ বিরোধীদের দেশে আসতে পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল, তাদের নিয়ে রাজনৈতিক জোট গঠন এবং সরকার গঠনÑএ সব তো নতুন কথা নয়। অথচ এ সবকে বাদ দিয়ে তরিকুল ইসলাম এবং তার এককালের বিপ্লবী সতীর্থÑযারা এখন বিএনপির রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়Ñতারাই সুযোগ পেলে স্বাধীনতার পর ৪০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা হত্যার কথা বলেন। ওই মুক্তিযোদ্ধা হত্যার সঙ্গে তখন কারা জড়িত ছিলেন তা যদি বলতেন; সেই হত্যাকা-কে স্বাভাবিক সন্ত্রাসী কর্মকা- বলা হবে, নাকি মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে চিহ্নিত করবেনÑতা তরিকুল ইসলাম সাহেবকে স্পষ্ট করে বলতে অনুরোধ করব। এর জন্য তাঁকে এই আইনের ধারাগুলো ভালভাবে পড়াশোনা করে কথা বলতেও অনুরোধ করব।
তবে বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ট্রাইব্যুনালের রায়ের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে যা বলেছেন তাতে বোধহয় অবাক হওয়ার কিছু নেই। গয়েশ্বর রায়ের কথাবার্তা এমনই; এগুলো মিডিয়াকে বেশ আকর্ষণ করে মাত্র। তাই এসব কথা মিডিয়ায় একটা স্থান পেয়েও থাকে। তাতে তার একটা পরিচিতি আসে। তিনি এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ‘এটি নাটক কিনা’Ñএ প্রশ্নও তুলেছেন। পত্রিকায় গয়েশ্বর বাবুর এমন বক্তব্য পড়ে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম। বিষয়টি আদালতের রায়কে কেন্দ্র করে তার দেয়া। এর জবাব তাকেই দিতে হবে। তবে বিএনপি নেতৃবৃন্দের এসব বক্তব্যে যে বিষয়টি পরিষ্কার হচ্ছেÑতা কাউকে নতুন করে বলার কিছু নেই। বিএনপির এমন স্ববিরোধী অবস্থান বিএনপিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা যদি দলটির নেতৃবৃন্দ না ভাবেন তা হলে এ দলের নেতাকর্মীরা সমাজে কতটা বুক ফুলিয়ে চলতে পারবেন তা জানি না। এ মুহূর্তে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা সামাজিকভাবে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে, বিএনপিরও একটি অংশ এতে ক্ষুব্ধ হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের রাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বিএনপি একটি ডানের দলে পরিণত হওয়ার অভিযোগটি ক্রমেই সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে। বিষয়টি বিএনপিই এখন ভাল করে বুঝবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.