তুরস্কের ক্ষমার সুপারিশ মেনে নেওয়া হবে নাঃ দীপু মনি

পরাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, যুদ্ধাপরাধে দোষী কোনো ব্যক্তির শাস্তি মওকুফের সুপারিশ বাংলাদেশের পক্ষে মেনে নেওয়া হবে না। কারণ, এটি সারা দেশের জনগণের দাবি এবং এটি একটি সংবেদনশীল বিষয়।
রোববার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার নিজ কক্ষে যুদ্ধাপরাধে দোষী ব্যক্তিদের ক্ষমা করার অনুরোধ জানিয়ে সরকারকে তুরস্কের রাষ্ট্রপতির পাঠানো চিঠি প্রসঙ্গে সাংবাদিকরা তার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চান। জবাবে তিনি একথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘‘তুরস্ক তাদের দেশেও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। আর বাংলাদেশে এ বিচার প্রচলিত আইনেই আমরা করছি।’’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘তুরস্কের রাষ্ট্রপতি আবদুল্লাহ গুল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে  যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে চিঠি দিয়েছেন।
অন্যদিকে তুরস্কের ১৪ সদস্যের একটি এনজিও প্রতিনিধিদল অন-অ্যারাইভ্যাল ভিসার সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন।’’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘এ বিষয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়নি। কারণ, তুরস্ক জানিয়েছে, এ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এখানে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত তাদের যে সহযোগিতা করেছেন, তাদের সাধারণ নাগরিকদের সেবা দেওয়ার মতো করেই।’’

চিঠির জবাব দেওয়া হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘চিঠিটি যেখানে গেছে সেটি সেখানকার বিবেচ্য বিষয়- চিঠির জবাব হবে কি হবে না।’’   

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। অন্যদিকে তুরস্কে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সেদেশের সরকারের সঙ্গে কথা বলেছেন। বাংলাদেশ তাদের অবস্থান তুরস্কের সরকারকে জানিয়েছে।’’

‘‘মূল কথা হলো তুরস্কের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে,  তুরস্ক বাংলাদেশের কোনো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চায় না বা চায়নি। একটি বন্ধু রাষ্ট্র প্রধান আর একটি বন্ধু রাষ্ট্র প্রধানের কাছে চিঠি লিখেছেন এবং এ বিষয়টি আমাদের  দেশের জন্য যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল বিষয়, এ কারণেই এটিকে খুব সহজেই বাংলাদেশের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়।’’

‘‘তাছাড়া সারা দেশে এটি নিয়ে বড় আকারের প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ ৪০ বছর অপেক্ষা করেছে । মানুষের আশা, এ বিচারটি সুসম্পন্ন হবে, বিচারটি চলছে। এ বিচারের বিষয় নিয়ে কেউ যেন এ ধরণের  দোষীদের বা দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন এমন ব্যক্তির পক্ষে সুপারিশ করতে না পারেন স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশি মানুষদের সেটাই চাওয়া।’’

দীপু মনি আরও বলেন, ‘‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন কি তুরস্কেও যারা যুদ্ধাপরাধ করেছেন, তাদেরকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশে এটির বিচার সম্পূর্ণ দেশীয় আইনের অধীনে গঠিত একটি ট্রাইব্যুনালে হচ্ছে। বিচার কার্যক্রম আইন অনুযায়ী সম্পন্ন হচ্ছে এবং সে অনুযায়ী রায় হবে। এ বিষয়টি নিয়ে কোথাও যেন অস্বচ্ছতা না থাকে সে বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।’’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘তুরস্কের প্রতিনিধি দলে কারা কারা এ ভিসার সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশে  এসেছেন এখনও তা জানার চেষ্টা চলছে। আসলে কারা এ ধরনের ভিসা পেতে পারেন, তাও যাচাই করা হচ্ছে।’’

তিনি বলেন, ‘‘তাদের সঙ্গে আমাদের যে ভিসা সংক্রান্ত যে চুক্তি রয়েছে সে বিশেষ ক্যাটাগরির পার্সপোট বাহকরা অন-অ্যারাইভ্যাল ভিসা পেলেও বাংলাদেশে যে কাজগুলো করেছেন, তা তারা করতে পারেন না।’’ 

‘‘কি কাজের জন্য তাদের যে ধরনের ভিসা দেওয়া হয়, এ ক্ষেত্রে তাদের কাজও সুনির্দিষ্ট। তাই তারা দেশে এসে কার সঙ্গে কথা বলতে পারেন তা নিয়েও সীমাবদ্ধতা রয়েছে’’ বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। 

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল গত ২৩ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের কাছে তুর্কি ভাষায় (সঙ্গে ইংরেজি অনুবাদ)এক পৃষ্ঠার একটি চিঠি পাঠান।যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গোলাম আযমসহ যাদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে, চিঠিতে তাদের ক্ষমা করে দেওয়ার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও একই চিঠি পাঠান প্রেসিডেন্ট গুল।

চিঠিতে গুল লিখেছেন, গোলাম আযমের বয়স ৯০ বছরের ওপরে এবং যাদের বিচার করা হচ্ছে তাদের অধিকাংশই প্রবীণ। তিনি গোলাম আযমসহ অভিযুক্ত অন্য সব জামায়াত নেতাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই দেওয়ার আহ্বান জানান।

গুল আরও লেখেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারে অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিলে তা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এটি কূটনৈতিক নীতিমালায় একটি অন্যায্য আবদার। ঢাকা এ বিষয়ে আংকারার ওপর বেশ ক্ষুব্ধ। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে তুরস্কের মতো দেশের এ ধরনের অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়ে সরাসরি সুপারিশ দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি করেছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সরকারের একটি নির্বাচনী অঙ্গীকার। এ থেকে পিছিয়ে আসার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের কারো শাস্তিও আদালত এখনও ঘোষণা করেননি। কিন্তু রায় ঘোষণার আগে তুরস্কের  প্রেসিডেন্টের এ ধরনের চিঠি বিচার কার্যক্রমকে ব্যাহত করারই চেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে।

এছাড়া তুরস্কের ক্যানসুয়ু এইড অ্যান্ড সলিডারিটি অ্যাসোসিয়েশনের ১৪ সদস্যের একটি ‘এনজিও’ প্রতিনিধিদল সম্প্রতি অন-অ্যারাইভ্যাল ভিসা (আগমন-পরবর্তী ভিসা) নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে লবিং করতে বাংলাদেশে আসে। প্রতিনিধি দলটি পাঁচ দিনের বাংলাদেশ সফরে এসে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন এবং বিচার-সংক্রান্ত বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। তারা মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও বিরোধী দলের একজন শীর্ষ নেতার সঙ্গেও বৈঠক করেন। তারা তুর্কি সরকারের মদদপুষ্ট একটি এনজিও। ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন তুরস্কের একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রী।  এছাড়া ছিলেন সাবেক এমপি, রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী।

আঙ্কারার বাংলাদেশ দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, এ প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে তারা `অন অ্যারাইভাল ভিসা` নিয়েছেন।

আসামিপক্ষ লবিং করে তুরস্কের এই এনজিও প্রতিনিধি দলটির সফরের আয়োজন করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট গুলের চিঠির পর এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, তুরস্ক জেনে-শুনেই এ প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিল।

এরপরই ২৫ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন,  ‘‘তাদের সঙ্গে আমাদের ভিসা সংক্রান্ত যে চুক্তি রয়েছে, সে বিশেষ ক্যাটাগরির পাসপোর্ট বাহকরা অন-অ্যারাইভ্যাল ভিসা পান। সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে তারা এমন একটি কাজ করেছেন, যা সঠিক কাজ নয়।’’ 

সূত্র জানায়, এ ধরনের কর্মকাণ্ড সরকার খুবই গুরুত্বের সাথে (সিরিয়াসলি)নিয়েছে। তুরস্কের এহেন তৎপরতাকে বাংলাদেশ তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ’ বলে মনে করছে। এ কারণে বাতিল করা  হতে পারে দুই দেশের মধ্যে অন-অ্যারাইভ্যাল ভিসার সুবিধা। ২০০৯ সালে ঢাকা এ ধরনের ভিসার প্রস্তাব দিলে চলতি বছরের মাঝামাঝিতে এটি অনুমোদন করে আংকারা।

গত ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মেহমেত ভারকুল ইরকুলকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়।  মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশ সফরে এসে সেদেশের এনজিও প্রতিনিধি দল যে অস্বাভাবিক তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ে, এ বিষয়ে তুর্কি রাষ্ট্রদূতকে সরকারের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া তুরস্কের প্রেসিডেন্টের লেখা চিঠি সম্পর্কেও তার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।

রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে তুরস্ককে এ বিষয়ে চিঠিও পাঠায় বাংলাদেশ। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘‘কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো রকম আগাম সংবাদ না দিয়েই তুরস্কের এনজিও প্রতিনিধিদলের ঢাকায় আগমন বাংলাদেশের কাছে ‘অসৌজন্যমূলক’ মনে হয়েছে। রাজধানীতে পাঁচ দিন অবস্থানে প্রতিনিধিদলটি অস্বাভাবিক তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ে। ঢাকায় তুরস্কের দূতাবাসও সার্বক্ষণিকভাবে তাদের সব কর্মসূচিতে অংশ নেয়। দূতাবাসের এ ভূমিকা অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক। তাই পুরো বিষয়টিতে তুরস্কের সরকারের ভূমিকা নিয়ে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।’’

বাংলাদেশের চিঠিতে আরো বলা হয়, ‘‘এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কঠোর ভাষায় বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র তুরস্কের এ ধরনের তৎপরতার নিন্দা জানায়। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অব্যাহত রাখার স্বার্থে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপ্রত্যাশিত তৎপরতা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ারও তাগিদ দেওয়া হয় চিঠিতে।’’

এর পাল্টা হিসেবে পরদিন আংকারায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমানকে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। তাকে তুরস্কের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ওমর অনহুন।

সব মিলিয়ে এ নিয়ে ঢাকা-আঙ্কারার মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.