নিত্যজাতম্-দুদকের অ্যাসেট ইনকোয়ারি by মহসীন হাবিব

পৃথিবীর সব উন্নয়নশীল দেশেই কমবেশি দুর্নীতি আছে। সংখ্যায় অল্প হলেও সভ্য দেশ বলে পরিচিত দেশগুলোতেও যে একেবারেই দুর্নীতি নেই তা কিন্তু নয়। তবে যেখানেই দুর্নীতি হোক না কেন, একটি বিষয় পরিষ্কার।
তা হলো, দুর্নীতি করে থাকেন প্রধানত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, যাঁদের হাতে কাগজ-কলম রয়েছে। আর এই কর্মকর্তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে কখনো কোনো ব্যবসায়ী, কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া কিছু মানুষ। যাঁরাই এ দুর্নীতি করেন তাঁরা কাগজ-কলম ঠিক রেখে টেবিলের নিচ দিয়ে লেনদেনটা সেরে ফেলেন। খুব সাধারণ একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটি পরিষ্কার করা যাক। ধরুন, অফিস থেকে কাগজ, কালি, কলম, পিন কেনার ভাউচার দেওয়া হলো। দেখবেন, সেখানে খাতা-কলমের হিসাবে কাগজ এসেছে। যে দোকান থেকে কেনা হয়েছে, সেই দোকানির স্বাক্ষরসহ রিসিটও আছে। ধরুন, এবার তিন মাসের জন্য কেনা কাগজ-কলমের অর্থ মেরে দেওয়া হয়েছে বলে দুদকে একটি অভিযোগ এলো। দুদকও ধরুন সততার সঙ্গে (অন্তত ধরে নিন, অন্য কথায় পরে আসছি) ব্যবস্থা গ্রহণ করার ইচ্ছা রাখল। এবার তদন্তের জন্য কর্মকর্তা নির্দিষ্ট করা, তদন্তের অনুমোদনলাভসহ যখন মাঠে নামা হলো, তখন কাগজ-কলম আরেক দফা ক্রয়ের সময়। যাঁর বা যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। এবার প্রমাণের উপায় কী? অত্যন্ত দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোনো সৎ কর্মকর্তা ছাড়া এই চৌর্যবৃত্তি প্রমাণ করা কী সম্ভব? এবার বলি কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির একটি সম্ভাবনার কথা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পের অধীনে কোটি কোটি টাকার ব্লক ফেলার কাজ চলে আসছে ভাঙনপ্রবণ নদীতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই এ ব্লক ফেলার কাজ হয়ে আসছে। কত ব্লক এক দিনে তৈরি করা হলো, ব্লক তৈরির কাজ কোন কমিটি তদারক করল, কোন রেজিস্টারে তা তোলা হলো- এ সব কিছুর পর মাত্র জনাদশেক লোক সমঝোতায় এলেই একটি প্রকল্প থেকে অনায়াসে পাঁচ থেকে ১০ কোটি টাকার দুর্নীতি করা কোনো সমস্যাই নয়। একবার হজম করে ফেললে তা দুদকের সাধ্য নেই আর খুঁজে বের করার। কারণ ব্লকগুলো উত্তাল নদীতে ফেলার পর আর খুঁজে বের করার কোনো প্রযুক্তি হাতে নেই যে এক হাজারটি ব্লক ফেলা হয়েছে, নাকি এক লাখ ব্লক ফেলা হয়েছে (সুখের কথা, সম্প্রতি নাকি এ বিভাগে উচ্চ পর্যায়ে একজন প্রকৌশলী এসেছেন, যিনি অত্যন্ত সৎ জীবন যাপন করেন। শুনতেও ভালো লাগে। এমন প্রকৌশলীর জন্য মনের গভীর থেকে শ্রদ্ধা ও শুভ কামনা)।
এমন প্রতিটি ক্ষেত্রেই ফিল্ডে নেমে দুর্নীতি প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। তাহলে কী দাঁড়াল? দুর্নীতি ধরার উপায় কী?
উপায় আছে। অতি সহজ উপায় আছে। সেই উপায়টিই দুর্নীতিবাজদের ধরার এবং দুর্নীতি রোধ করার একমাত্র পথ বলা যায়। তা হলো, যেকোনো ব্যক্তির আয়ের সঙ্গে সম্পদের অসংগতি খতিয়ে দেখা, যাকে দুদকের ভাষায় বলা হয়ে থাকে অ্যাসেট ইনকোয়ারি। খালি চোখে যে পরিমাণ তথ্যপ্রমাণ বাংলাদেশে রয়েছে, সে ব্যাপারে দুদক যদি পদক্ষেপ নেয়, তাহলেই দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটে যাওয়া সম্ভব। ওপর মহলের কথা বাদ দিলাম, বাংলাদেশের অসংখ্য ভূমি অফিসের তহশিলদার, বিদ্যুতের মিটার রিডার, কাস্টমসের পিয়ন, হাসপাতালের বয় পর্যন্ত রয়েছে, যারা কোটি কোটি টাকার মালিক। আক্ষরিক অর্থেই রূপকথাকে হার মানাচ্ছে এরা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই ঢাকা শহরে তৃতীয়, এমনকি চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি কর্মচারী পাজেরো জিপ চালিয়ে ঘুরছে। সারা দেশে এমন একজন পিআইও পদে কর্মরত ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার চাকরির বয়স হয়েছে পাঁচ বছর অথচ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা সম্পদের হিসাবে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা নেই। এদের কাছ থেকে শুধু একটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়াই যথেষ্ট, এ সম্পদের উৎস কী?
এমন যখন সার্বিক চিত্র, তখন বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা গেছে, দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কিছুদিন আগে দুদক কনফারেন্সে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনাকালে নির্দেশ দিয়েছেন, অ্যাসেট ইনকোয়ারি নিরুৎসাহিত করতে হবে। আরো জানা গেছে, তখন থেকেই দুদকের অ্যাসেট ইনকোয়ারি অনুমোদন প্রায় প্রায়ই দেওয়া হচ্ছে না। খুবই হতাশ হওয়ার মতো কথা। বিশ্বের যেসব দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন রয়েছে, তার প্রতিটিরই প্রধান হাতিয়ার অ্যাসেট ইনকোয়ারি। সিয়েরা লিওনের এন্টি-করাপশন কমিশনার জোসেফ ফিৎজেরাল্ড কামারা দায়িত্ব নিয়েছেন বছরখানেক হলো। ইতিমধ্যে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছেন। ১২ তারিখের বিশ্ব দুর্নীতি দমন দিবস উপলক্ষে এক ভাষণে তিনি বলেছেন, সরকারের সম্পদ ও রাষ্ট্রের তহবিল অপব্যবহার করা জাতির জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহের জন্য ছোট-বড় ব্যবসায়ী, এমনকি গাড়িচালকদেরও সহায়ক শক্তি হিসেবে নিয়োজিত করেছেন। উল্লেখ্য, সিয়েরা লিওনের দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন হয়েছিল ২০০০ সালে এবং এর আইনি কাঠামো ছিল অত্যন্ত দুর্বল। কিন্তু ২০০৮ সালে সেটি সংশোধন করে কমিশনকে যথেষ্ট শক্তিশালী করা হয়েছে।
আমাদের স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন কতটা স্বাধীন তা নিয়ে জনমনে বহু দিন থেকেই প্রশ্ন আছে। সেটা বিরোধী দলের বিরোধিতাপূর্ণ বক্তব্যের কারণে নয়, দুর্নীতি দমন কমিশনের বহু উল্টাপাল্টা আচরণের কারণে। দুদক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সেল চায়, নিজস্ব ফোর্স চায়, আসামি শনাক্তকরণে টেলিফোন ট্র্যাকিং সুবিধা চায়; কিন্তু আসল জিনিস চায় না। সেটি হলো সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান, যে প্রতিষ্ঠান চিনবে না কে কতটা ক্ষমতাধর। অন্যদিকে চেয়ারম্যান মহোদয়ের কী উচিত নয় একটি সার্কুলেশন দেওয়া যে কোনো দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মকর্তা-কর্মচারী কোনো ধরনের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রাখতে পারবে না। তিনি কি একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে পারেন না, কোন কর্মকর্তা কোন রাজনৈতিক দলের অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করেন বা নেতার সঙ্গে দেখা করেন তার সম্পর্কে নজর রাখতে?
দুদক চেয়ারম্যান নিজে বিশ্বাস করেন, এ দেশের প্রত্যেক মানুষ তাঁর ক্ষমতাকে টাকায় রূপান্তর করে। সেই চেয়ারম্যান যখন অ্যাসেট ইনকোয়ারিকে নিরুৎসাহিত করার নির্দেশ দেন, তখন ভয় হয়। বহু কারণে ভয় হয়। জানতে ইচ্ছা করে, কার অ্যাসেট বাঁচানো দরকার? অবশ্যই দুদকের এখনো অনেক লজিস্টিক সাপোর্টের ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু তার আগে প্রয়োজন দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে এবং আইনি দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানো। খোঁড়া ছেলেকে ফুটবল দিলে খেলতে পারবে না, মনঃকষ্টই শুধু বাড়বে।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.