চিরঞ্জীব কমরেড মণি সিংহ- দুর্গা প্রসাদ তেওয়ারী

ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী, টংক আন্দোলনের মহানায়ক, মুক্তিযুদ্ধাকালীন প্রবাসী সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা, কৃষক-শ্রমিক মেহনতী মানুষের মুক্তি সংগ্রাম ও সমাজতন্ত্রের মহান নেতা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কমরেড মণি সিংহ স্মরণে প্রতিবছরের মতোই মণিদার টংক আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত সুসং দুর্গাপুরের টংক স্মৃতিস্তম্ভ প্রাঙ্গণে এবারও আয়োজিত হচ্ছে মণি সিংহ মেলা।
গত ২১ বছর যাবৎ মণিদার প্রয়াণ দিবস ৩১ ডিসেম্বর ৭ দিনব্যাপী এ মেলা সুসং দুর্গাপুরবাসী দলমত নির্বিশেষে আয়োজন করে। স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে যখন সর্বক্ষেত্রে বিভেদ-বিভাজন, হিংসার রাজনীতি আজ প্রতিষ্ঠিত তখন দেশের এই প্রত্যন্ত প্রান্তে মণিদার আদর্শ, সততা ও ত্যাগ সকল দলমতকে একীভূত করে সকলের যৌথ প্রচেষ্টায় আমরা এই মেলা সফলভাবে সম্পন্ন করে আসছি। এই মেলার প্রধান উদ্দেশ্য এই মহাপুরুষটি সমগ্র জীবনের সংগ্রাম, সততা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, সত্যনিষ্ঠা, আদর্শিক জীবন-যাপন, কষ্ট সহিষ্ণু মানসিকতা, ব্যাপকভাবে ফুটিয়ে তুলতে। ৭ দিনব্যাপী বিভিন্ন আলোচনা, সাংস্কৃতিক কর্মকা-, নাটক, গানের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করা হয় তার আদর্শকে।
আজকের রাজনীতির সংজ্ঞা যখন উঠেছে লোভ-লালসা, ভোগবাদী চিন্তা, যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে অর্থ উপার্জন, আদর্শনীতিহীন জীবন-যাপন। ধর্মীয় মৌলবাদের নিকট আপোস করে ৩০ লাখ শহীদের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার অপচেষ্টা চলছে এমনি মুহূর্তে মণিদার বড় প্রয়োজন। নব প্রজন্মের মাঝে সত্যিকার দেশপ্রেম, ত্যাগ, লোভ-লালসাহীন জীবন, এককেন্দ্রিক জীবন-যাপনের চিন্তাবিহীন মানসিকতা, পরোপকারী ও সামাজিক, দৃঢ় মানসিকতা তৈরি করতে এ মণি মেলার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা।
আমাদের গর্ব, আমাদের প্রিয় জন্মভূমি, সুসং দুর্গাপুরে জন্মেছিলেন এই মহান মানুষটি। স্বল্প কয়েক লাইন দিয়ে এই সংগ্রামী মানুষটির কর্মরেখা বর্ণনা দেয়া প্রায় অসম্ভব। আমার পরম সৌভাগ্য, আমি এই মহান নেতার সান্নিধ্য পেয়েছি। আমার ৮২ বছরের জীবনের শুরুতেই আমি দেখতে পাই কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে সুসং মহারাজদের স্বৈরাচারী, টংক প্রথার বিলুপ্তির লক্ষ্যে এক বিশাল গণঅভ্যুত্থান। প্রসঙ্গত মণিদা ছিলেন সসুং মহারাজদের ভাগ্নে। কমিউনিস্ট আদর্শে দীক্ষিত তরুণ বিপ্লবী মণিদাকে কোন মোহই রাজপরিবারের আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও গণমানুষের ন্যায্য দাবির আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। এই টংক আন্দোলন তৎকালীন রাজারা ব্রিটিশ সরকারের সাহায্যে ব্যাপক দমন নীতি চালিয়েও স্তব্ধ করতে পারেনি। উল্লেখ্য, টংক প্রথা ছিল সুসং জমিদারদের নির্যাতনমূলক এক প্রথা। প্রতি একর জমিতে ৮-১২ মণ ধান খাজনা দিতে হবে কৃষকের ফসল হোক বা না হোক। এই আন্দোলন পরবর্তীতে সশস্ত্র রূপ নেয়। উপমহাদেশের ভৌগোলিক ভাগাভাগিতে পরর্তীতে পাকিস্তান সরকারের চরম নির্যাতনমূলক পদক্ষেপ ও জমিদারী শাসন ব্যবস্থা উচ্ছেদের ফলে টংক আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়। মণিদাসহ সব কর্মীর উপর চরম নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে পাকিস্তান সরকার। আত্মগোপনে ও জেলে থাকতে হয় মণিদাকে। বহু কর্মী দেশান্তরী হতে বাধ্য হন। মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে সমগ্র কমিউনিস্ট বিশ্ব, তথা তৎকালীন বৃহৎ পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নকে (বর্তমান রাশিয়া) আমাদের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে দাঁড় করাতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি-ন্যাপ ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয় এক বিশাল গেরিলা বাহিনী যা আমাদের স্বাধীনতাকে সফলতার দিকে বেগবান করে তুলেছিল।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নিকট ছিল তাঁর আস্থার অগ্রজ-অনুজ সম্পর্ক। বঙ্গবন্ধু মণিদাকে সম্মান করতেন, দাদা বলে ডাকতেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরামর্শ নিতেন। সম্ভবত ১৯৭৩-এর প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধু তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে যেতে বললেন একদিন। আমি সমস্ত কাগজপত্র দুর্গাপুর থেকে যোগাড় করে মণিদাকে দিলাম। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, টংক আন্দোলনের শরিক সকলের বাড়িঘর, জমিজমা পাকিস্তান সরকার রিফিউজিদের মাঝে বন্দোবস্ত দিয়েছে। এই নির্লোভ মানুষটি সেদিন বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, সকলের বাড়ি ফেরৎ দিতে পারলেই আমি আমার নিজের বাড়িটি নেব। তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সুসং দুর্গাপুরের ডিগ্রি কলেজটি মহারাজ ভূপেন্দ্র কুমার সিংহ শর্মার বাড়ি ছিল। ৪ একর জায়গার বাড়িটি বঙ্গবন্ধুকে বলে তিনি কলেজের নামে স্থায়ী বন্দোবস্ত করে দেন। স্বাধীন দেশে প্রতিটি সংগ্রামে তিনি ছিলেন সর্বাগ্রে। ১৯৭২-১৯৮২- এই সময়ে বেশ কয়েকবার এই অঞ্চলে এসেছিলেন সংগঠন করার কাজে। মণিদার স্বপ্ন একটি শোষণহীন, ধনী-গরিবের বৈষম্যহীন, অসম্প্রাদায়িক গণমানুষের সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের। জীবনের ৩৩টি বছর জেল, জুলুম, হুলিয়া নিয়ে কাটিয়েছেন এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা আজও মণিদার এই স্বপ্নকে লালন করি।
মণি মেলা উদ্দেশ্যই মণিদার স্বপ্নকে বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের মাঝে বিলিয়ে দিতে। তারা যেন এই মহাপুরুষের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের জীবন ও একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ায় ভূমিকা রাখতে পারে। পরিশেষে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই, আলোকবর্তিকা এই মহান পুরুষটি।

লেখক : কমরেড মণি সিংহের ঘনিষ্ঠ সহচর ও আহ্বায়ক
কমরেড মণি সিংহ মেলা উদযাপন কমিটি

No comments

Powered by Blogger.